ওদের বিপদ, আমাদের উৎসব
২৪ অক্টোবর ২০১৬ক'দিন আগের ঘটনা৷ শহরের উপকণ্ঠে বারাসতের দত্তপুকুর এলাকায় একটি বাড়িতে বেআইনি বাজি তৈরি করার সময় বিস্ফোরণ ঘটে মারা যায় নবম শ্রেণির ছাত্র একটি ১৭ বছরের ছেলে৷ বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে পাড়ার লোক ওই বাড়িটিতে গিয়ে দেখেন ঘরের ভেতরে আগুন জ্বলছে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ৷ কোনোমতে দরজা ভেঙে তাঁরা ওই কিশোরকে উদ্ধার করেন৷ কিন্তু ততক্ষণে এমনভাবে আগুনে ঝলসে গিয়েছিল সে, যে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি৷ এই ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, দত্তপুকুর এলাকায় শুধু ওই একটি বাড়ি নয়, অনেক বাড়িতেই উৎসবের আগে এরকম বেআইনি বাজি বানানোর কাজ হয়৷ বসত এলাকায় যা অত্যন্ত বিপজ্জনক৷
সামান্য দুর্ঘটনা থেকেই বহু মানুষের প্রাণসংশয় হতে পারে৷ এবং তেমন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও যথেষ্ট৷ কারণ, বাজি কারখানার জন্যে সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়ম–বিধি কিছুই পালিত হয় না এইসব গোপন বাজি কারখানায়৷ থাকে না আগুন নেভানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা৷ ফলে প্রতি বছরই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানি হয়৷
এক্ষেত্রে আরেকটা মারাত্মক ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলে৷ যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, দেখা যায় হতাহতদের মধ্যে অনেক কমবয়সি ছেলে–মেয়েও থাকে৷ উপরি রোজগারের লোভ দেখিয়ে, কিন্তু কম মজুরিতে অদক্ষ এই ছেলে–মেয়েদের বাজি তৈরির কাজে লাগানো হয়৷ দত্তপুকুরের দুর্ঘটনাতেই যেমন, প্রতিবেশী কিশোরকে মাত্র ১৫০ টাকা মজুরির টোপ দিয়ে বাজি তৈরিতে লাগানো হয়েছিল, যার সে কাজে কোনো দক্ষতা, বা অভিজ্ঞতা ছিল না এবং পাছে সে কাজে ফাঁকি মারে, ঘরের বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যাওয়া হয়েছিল৷
পশ্চিমবঙ্গে সব থেকে বেশি আতসবাজি তৈরি হয় মেদিনীপুর জেলায় এবং প্রায় সবই বেআইনি বাজি কারখানা৷ ঘন জনবসতি এলাকায়৷ বছরের বাকি সময় এই জেলার বাসিন্দারা কৃষিকাজ, পশুপালন, পাইকারি ব্যবসায় ব্যস্ত থাকলেও উৎসবের আগে গোটা এলাকাজুড়ে ঘরে ঘরে বাজি তৈরি হয়৷ ছেলে–বুড়ো হাত লাগায় বাজি তৈরিতে, এমনকি ঘরের মেয়েরাও৷ অনেক মহিলাই কাজের সময় নিজেদের শিশুদের সঙ্গে রাখেন৷ কার্যত বারুদের স্তুপের ওপর বসে থাকে এখানকার সবকটি পরিবার৷
বেশিরভাগই মুসলিম প্রধান গ্রাম, গরিব৷ আতসবাজি তৈরি তাদের কাছে বাড়তি রোজগারের এক বাড়তি সুযোগ৷ প্রশাসন এই আতসবাজি তৈরির বেআইনি কারবার বন্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয় না৷ মাঝে মধ্যে পুলিস ‘রেইড' করে বটে, কিন্তু বোঝা যায়, তা অনেকটা দায়সারা৷
জনজীবন নিরাপদ করার দায়িত্ব পালনের থেকে আইন–শৃঙ্খলা বজায় থাকলেই প্রশাসন খুশি৷ বাজি তৈরির এই কাজকে যদি এক ছাতার তলায় আনা যেত, তা হলেও একটা সংগঠিত বাণিজ্যিক উদ্যোগের চেহারা নিত, একটা অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ থাকত তার, কারণ, শুধু উৎসবের মরশুমে নয়, পশ্চিমবঙ্গে সারা বছরই বাজির একটা চাহিদা থাকে৷ সে বিয়ে–শাদিতে হোক, কিংবা বছরভর নানা খেলার বিজয় উৎসব পালনের সময়৷ কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগও কখনো কোনো সরকার দেখায়নি৷ পুরো কাজটাই একটা অসংগঠিত, বিচ্ছিন্ন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উদ্যোগ হয়েই থেকে গেছে৷
নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই৷ না মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে, না নিরাপত্তা ব্যবস্থায়৷ কোনো বিধিবদ্ধ আচরণের তোয়াক্কা কেউ করে না৷ ফলে যা ঘটার, ঘটছে৷ প্রায় প্রতি বছরই দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রাণহানি হচ্ছে, আর তার থেকেও বড় কথা, অল্পের জন্যে এড়িয়ে যাচ্ছে আরো বড় বিপর্যয়৷