জার্মান ভিসা নাকচ হয় কেন?
১৯ জুন ২০১৮এশিয়ায় প্রতি ১০টি আবেদনের মধ্যে একটি নাকচ
ডয়চে ভেলের একদল সাংবাদিক ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে জার্মান দূতাবাসগুলিতে ভিসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করেছেন৷ তবে শেঙেন চুক্তির অধীনে স্বল্পমেয়াদি ভিসা নয়, উচ্চশিক্ষা, চাকুরি অথবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জার্মানিতে বসবাস করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি ভিসাই ছিল তাঁদের গবেষণার লক্ষ্য৷
সবার আগে তাঁদের একটি বিষয় চোখে পড়ে৷ ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বে জার্মান দূতাবাসগুলিতে ভিসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রায় ৫৮ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ অন্যদিকে ভিসার আবেদন নাকচ করার ঘটনা বেড়েছে ১৩১ শতাংশ৷ এই সময়কালে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা নিয়ে যত বিদেশি জার্মানিতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ এশিয়ার মানুষ৷ সেখানে প্রতি ১০টি আবেদনের মধ্যে কর্তৃপক্ষ একটি নামঞ্জুর করেছেন৷ তবে এ ক্ষেত্রে দেশ অনুযায়ী বিশাল পার্থক্য চোখে পড়ার মতো৷ যেমন বাংলাদেশে প্রতি ৪টি আবেদনেরমধ্যে একটি নাকচ করা হয়েছে৷ অথচ চীনে প্রতি ২০টি আবেদনের মধ্যে একটি এবং জাপানে প্রতি ১০০টি আবেদনের মধ্যে একটি বিফল হয়েছে৷
এমন পার্থক্যের কারণ কী?
জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডয়চে ভেলের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছে যে, স্থানীয় দূতাবাসই সারা বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য নিরপেক্ষ মানদণ্ড প্রয়োগ করে ভিসার জন্য প্রতিটি আবেদন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়৷ আবেদনকারীকে নিজের আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ পেশ করতে হয়৷ অর্থাৎ, জার্মানিতে বসবাসের জন্য যথেষ্ট অর্থ হাতে থাকতে হবে অথবা জার্মানিতে এমন কাউকে চিনতে হবে, যিনি তাঁর জন্য সেই অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত৷ তাছাড়া জার্মানিতে বসবাসের বিশ্বাসযোগ্য কারণও জানাতে হবে৷ যেমন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসবাসের উদ্দেশ্য থাকলে স্বামী, স্ত্রী বা সন্তানকে তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের প্রমাণ পেশ করতে হবে৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ প্রসঙ্গে আরও জানিয়েছে যে, চাকুরির জন্য ভিসার ক্ষেত্রে আবেদন নাকচ হবার ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম৷ অন্যদিকে পারিবারিক কারণে জার্মানিতে বসবাসের জন্য ভিসা প্রায়ই নামঞ্জুর করতে হয়, কারণ, অনেক সময়ে ভুয়া নথিপত্র পেশ করা হয় অথবা আবেদনকারীর বসবাসের জন্য যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ থাকে না৷
এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক প্রান্তেই ভুয়া নথিপত্রএকটা বড় সমস্যা৷ এ কারণে জার্মানি আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ বেশ কিছু দেশের সার্টিফিকেটগুলিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না৷ ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ইরান সেই তালিকায় নেই৷ অসনাব্র্যুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসন গবেষক ইয়খেন ওল্টমার মনে করেন, কোনো দেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থা সে দেশের আবেদনকারীদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে৷
বিভিন্ন দেশের মধ্যে বড় পার্থক্য
এমন সব ‘কঠিন মানদণ্ড' ছাড়াও কিছু ‘নমনীয় মানদণ্ড'-ও রয়েছে৷ যেমন ভিসার মেয়াদের শেষে আবেদনকারীর দেশে ফেরার সম্ভাবনার মূল্যায়ন করা হয়৷ ওল্টমার মনে করেন, এর সঙ্গে আবেদনকারীর দেশের ভাবমূর্তিরও সম্পর্ক রয়েছে৷ সেই দেশ তথা মহাদেশের পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে৷ বিশ্বের কিছু প্রান্ত থেকে অভিবাসনের সম্ভাবনা বা বিপদ নিয়েও ভাবনাচিন্তা করা হয়৷
জার্মানির দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, আফ্রিকার দেশগুলিতে দারিদ্র্য ও বড় আকারের রাজনৈতিক ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে৷ সেখান থেকেই মূলত শরণার্থীরা আসে বলে ধরে নেওয়া হয়৷ অন্যদিকে এশিয়ার ভাবমূর্তি ভিন্ন৷ ভবিষ্যতের মহাদেশ হিসেবে সেখানে বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে বলে জার্মানিতে ধারণা করা হয়৷ অভিবাসনের কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চায় জার্মানি৷ ভারতের ভাবমূর্তি হলো, সেখানে অনেক কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ আছেন৷ জার্মানিতে তাঁদের বিপুল চাহিদা রয়েছে৷ বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে এশিয়া মহাদেশে চীনের গুরুত্ব সম্পর্কে জার্মানি অত্যন্ত সচেতন৷ অভিবাসন গবেষক ইয়খেন ওল্টমার বলেন, ‘‘গত ১০ থেকে ১৫ বছরে আমরা লক্ষ্য করছি যে, চীন থেকে জার্মানিতে ছাত্রছাত্রীদের আগমন অনেক বেড়ে গেছে৷'' জার্মানিতে এই প্রবণতা অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়৷ কারণ, তাঁরাই ভবিষ্যতে দুই দেশের অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের জগতে মেলবন্ধন ঘটাবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
ধর্মের গুরুত্ব
ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনকারীর ধর্ম কতটা গুরুত্ব পায়? বৌদ্ধদের তুলনায় মুসলিমদের ভিসা আবেদন কি নাকচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি? ওল্টমার মনে করেন, ধর্ম মোটেই প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে না৷ জার্মানিতে কোনো দেশের ভাবমূর্তিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ৷ যেমন, ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সে দেশের নরমপন্থি ভাবমূর্তি রয়েছে৷ সে কারণেই সম্ভবত সেখানে ভিসার আবেদন তুলনামূলকভাবে কম নাকচ করা হয়৷
ডয়চে ভেলের হাতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভিসার আবেদন করার সুযোগও দেশ অনুযায়ী ভিন্ন৷ যেমন, ওল্টমার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, গত ৩ বছরে আফগানিস্তানে প্রায় ৯,০০০ ভিসার আবেদন জমা পড়েছে৷ সংখ্যার বিচারে তা অত্যন্ত কম৷ অথচ ২০১৬ সালের শেষে জার্মানিতে বসবাসকারি আফগান নাগরিকদের সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ৷ তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে জার্মানিতে বসবাস করছেন৷ এমন অবস্থার জন্য আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও সেখানকার মানুষের অর্থাভাবই দায়ী বলে ওল্টমার মনে করেন৷ অনেক মানুষের পক্ষে কাছের কোনো জার্মান কনসুলেট অথবা কাবুলে জার্মান দূতাবাসে যাওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল৷ তার উপর এক সন্ত্রাসী হামলার ফলে ২০১৭ সালের মে মাস থেকে ২০১৮ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত কাবুলে জার্মান দূতাবাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷
সার্বিকভাবে বিভিন্ন জার্মান দূতাবাসে কর্মীসংখ্যার উপরেও অভিবাসনের মাত্রা নির্ভর করে৷ বড় আকারের দূতাবাসে যথেষ্ট সংখ্যক কর্মী থাকলে ভিসার অনেক আবেদন খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়৷ ছোট আকারের দূতাবাসে স্বল্পসংখ্যক কর্মী বেশি আবেদন পরীক্ষা করতে পারেন না৷ তবে ওল্টমার মনে করেন না যে, অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করতে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
সামগ্রিকভাবে তাঁর অভিমত হলো, বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির দিকে নজর দিতে হয়৷ জার্মানি সেই সব দেশ থেকে অভিবাসনে কতটা আগ্রহী, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে৷
দক্ষিণ এশিয়ায় ভুয়া সার্টিফিকেট, অসৎ আবেদনকারীদের ছলচাতুরি ভিসা দেবার ক্ষেত্রে সংশয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়৷ এমন পরিস্থিতিতে সোজা পথে, আবেদন প্রক্রিয়ার সব শর্ত পূরণ করে ভিসা পাবার চেষ্টা করলে সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে৷
এসবি/এসিবি