এমন বিপজ্জনক অবস্থা দিল্লিতে আগে দেখিনি
২১ এপ্রিল ২০২১মঙ্গলবার দুপুরের ঘটনা। বন্ধুর ছেলের সর্দি হয়েছে। সামান্য কাশিও। ঝুঁকি না নিয়ে করোনা পরীক্ষা করিয়ে নিতে চায়। বুধবার সকাল পর্যন্ত অসংখ্য জায়গায় চেষ্টা করেও পরীক্ষা করা যায়নি। সবার এক কথা, এক-দুই দিন পরে যোগাযোগ করবেন। সব বুকড। খবর নিয়ে জানলাম, করোনা পরীক্ষার চাপ এত বেশি যে, দিল্লির ল্যাবগুলি দিন দুয়েক নতুন করে নমুনা সংগ্রহের জন্য সম্ভবত কারো বাড়ি যাবে না। তা হলে করোনার উপসর্গ নিয়ে যারা বসে আছেন, তাদের কী হবে? কী আর হবে, হয় নিভৃতবাসে চলে যেতে হবে অথবা ঈশ্বর-ভরসায় থাকতে হবে।
আগে করোনা পরীক্ষা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার রিপোর্ট পাওয়া যেত। এখন রিপোর্ট পেতে ৪৮ ঘণ্টা লাগছে। ৭২ ঘণ্টা লাগলেও কিছু বলার নেই। আরেক বন্ধুর মেয়ে আগামী শনিবার দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরবে প্লেনে। করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট না দেখালে প্লেনে উঠতে দেবে না। হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কোথায় করোনা পরীক্ষা করা যাবে এবং শনিবারের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। বন্ধু ঘন ঘন ফোন করছে আমাকে। সমানে ফোন করেও লাভ হচ্ছে না। চিকিৎসকদের ফোন পাওয়া যাচ্ছে না। পেলেও তারা সুরাহা করতে পারছেন না। রাজনীতিকরা হাত তুলে রাখছেন। সাবেক উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারও কিছু করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিচ্ছেন। বন্ধুর মেয়ের বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত।
বুধবার সকালেই কলকাতা থেকে কলেজের বন্ধুর ফোন। তার আত্মীয় করোনায় আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। করা যাচ্ছে না। বিকেলে বন্ধু জানালো, কোনোরকমে একটা হাসপাতালে বেড পেয়েছে। ছেলের মাও করোনায় আক্রান্ত। তার কী হবে? উত্তর জানা নেই।
দিল্লিতে আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর অভিজ্ঞতা আরো শোচনীয়। তার এক বন্ধু লখনউতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কোনো হাসপাতালে জায়গা নেই। অনেক খুঁজে একটা বেড পাওয়া গেল। হাসপাতালের কর্তারা জানালেন, সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে আনতে হবে। লেখানোর জন্য তার ছেলে যখন ছোটাছুটি করছে, তখন খবর এলো, যার জন্য এই চেষ্টা তিনি আর নেই। একই অবস্থা হয়েছে এক সাবেক পুলিশ কর্মীর। তার স্ত্রী তাকে নিয়ে সারারাত হাসপাতাল খুঁজে বেরিয়েছেন। পাননি। সকালে সেই সাবেক পুলিশ কর্মী হাসপাতাল খোঁজার দায় থেকে স্ত্রীকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেই জীবনের সীমানা পেরিয়ে চলে গেছেন।
আরেক সাংবাদিক বন্ধুর ছেলের করোনা হয়ে অক্সিজেন লেভেল কমছে। অনেকে মিলে চেষ্টা করে হাসপাতালে একটা বেড জোগাড় করা গেছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসক বলছেন, ''আপনি তো এখন তুলনায় ভালো আছেন। আপনি বরং এখন ভর্তি হবেন না।'' হাসপাতালের অবস্থা দেখে বন্ধুর ছেলে পালিয়ে আসতে চাইছিল। থিকথিকে ভিড় ও অব্যবস্থা। রোগীর চাপে হাসপাতাল দিশেহারা।
দিল্লির সব হাসপাতালে একটাই রব, ঠাঁই নেই। হাসপাতালে ভর্তি হলেই সমস্যার সমাধান হবে তা নয়। অক্সিজেন দেয়ার দরকার হলে তা পাওয়া যাবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ, দিল্লির অধিকাংশ হাসপাতালে কয়েক ঘণ্টা বা এক-দুই দিনের মতো অক্সিজেন মজুত আছে। হাইকোর্টের কড়া মনোভাবের পর হাসপাতালে ভোর রাতে অক্সিজেন পৌঁছেছে। আজ না হয় সমস্যা মিটল। কাল, পরশু? কী হবে? উত্তর জানা নেই।
দিল্লির মতো শহরে যদি গড়ে ২৫ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হন, ত হলে এক সপ্তাহে এক লাখ ৭৫ হাজার মানুষের চিকিৎসা দরকার। এই হার চলতে থাকলে মাসে ছয় লাখ মানুষকে শুধু করোনার জন্য দিল্লিতে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে হবে। বর্তমান পরিকাঠামোয় যা অসম্ভব। কিন্তু ন্যূনতম প্রস্তুতি কেন ছিল না? না সরকারের, না মানুষের। অধিকাংশের মনে এমন ধারণা হয়ে গেছিল যে, করোনা চলে গেছে। মাস্ক পরা বন্ধ। সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। দিল্লিতে গত শুক্রবার রাত দশটা থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত কারফিউ জারি হয়। তার আগের বিকেলেও চিত্তরঞ্জন পার্কের বাজারে দেখেছি, প্রচুর মানুষ ভিড় করে ফুচকা খাচ্ছেন। আড্ডা চলছে। বিপদ দোরগোড়ায় না এলে চৈতন্য হয় না যে।
মহারাষ্ট্র সহ দেশের অন্য রাজ্যে হুহু করে করোনা বাড়ছে, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অন্য মন্ত্রীরা কেউ আসাম, কেউ তামিলনাড়ু, কেউ কেরালা, কেউ পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে ব্যস্ত। রাজ্যজয়ই তো আসল। মানুষ তো কতোই মরবে। করোনা না হলে অন্য রোগে। কিন্তু রাজ্যজয়ের সুযোগ তো পাঁচ বছরে একবার আসে। তা কি ছাড়া যায়! যায় না। করোনা যখন ভারতে এলো, তখন সব দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সব নিয়ন্ত্রণ করছিল। এখন দায় রাজ্যের ঘাড়ে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আর তার শেষ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী তো জনগণের ঘাড়েই কার্যত দায় চাপিয়ে দিয়েছেন।
দিল্লিতে দেখতে দেখতে প্রতিটি পাড়ায় করোনা ঢুকে পড়েছে। ঘরের পাশে হানা দিচ্ছে, চোখ রাঙাচ্ছে করোনা। প্রতিদিন খারাপ খবরে, মানুষের চলে যাওয়ার খবরে ভরে যাচ্ছে মেসেজ বক্স। ফোনের রিং বাজলে ভয় করতে শুরু করেছে। সত্যি বলছি, এমন বিপজ্জনক অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। না চাইলেও ভয় ঢুকে যাচ্ছে মনের ভিতর।