এমআইএম-কে দলে নিয়ে লাভ হবে তৃণমূলের?
২৪ নভেম্বর ২০২০পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণ যে প্রধান ফ্যাক্টর হতে পারে, তা কম বেশি সকলেই মানছেন। তৃণমূল এবং বিজেপির মূল রাজনৈতিক ঝোঁকও সে দিকেই। তারই মধ্যে বিহার নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলের কপালে ভাঁজ ফেলেছিল। আসাদুদ্দিন ওয়েইসির এমআইএম বিহারে পাঁচটি আসন পেয়েছে। কট্টর ইসলামপন্থী দলটি বিহারের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ জোটের ভোট কেটেছে বিভিন্ন পকেটে। বস্তুত, তাদের পাঁচটি আসন বিহার নির্বাচনের ভোল বদলে দিয়েছে। বিহারের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরেই এমআইএম জানিয়ে দিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গেও তারা আসন দেবে। ফলে পশ্চিমবঙ্গেও তাদের মুসলিম ভোট কাটার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। সোমবার তৃণমূলের রাজনৈতিক চাল সেই চিন্তার খানিকটা হলেও সুরাহা করতে পেরেছে।
সোমবার তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ এমআইএম-এর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা আনোয়ার হাসান পাশা। তৃণমূল ভবনে গিয়ে সপারিষদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে যোগ দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলই সব চেয়ে 'ধর্মনিরপেক্ষ' দল। বলা বাহুল্য, তাঁর মন্তব্যটি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক হওয়ার যথেষ্ট জায়গা আছে। যে রাজ্যে বামেদের অস্তিত্ব আছে, সেখানে তৃণমূলকে আদৌ সব চেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দল বলা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু এও ঠিক, এমআইএম-এর পক্ষে বামেদের সঙ্গে হাত মেলানো সম্ভব নয়। কারণ, তারা ধর্মভিত্তিক দল। বিহারেও যে কারণে তারা বামপন্থীদের নিয়ে তৈরি মহাজোটে যোগ দিতে পারেনি।
পশ্চিমবঙ্গে এমআইএম-এর নেতারা যখন তৃণমূলে যোগ দেন, তখন ধর্মনিরপেক্ষ মহল থেকে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে। উঠছেও। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির অনেকেই মনে করে, বিজেপি যেমন একদিকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির চাষ করে, এমআইএম-ও ঠিক তেমনই কট্টর ইসলামপন্থী রাজনীতি করে লাইম লাইটে থাকতে চায়। কোনো ভাবেই তাদের ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায় না। তাদের কার্যকলাপ নিয়েও নানা সময় নানা বিতর্ক হয়েছে।
এক সময় অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তৃণমূল। আজ তাদের দলেই এমআইএম-এর নেতারা যোগ দিচ্ছেন। তৃণমূলের তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না কারণ, নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করার কোনো দায় তাদের নেই। তৃণমূল বরাবরই ভোটের রাজনীতি করেছে এবং এখনো করছে।
পশ্চিমবঙ্গে প্রায় তিরিশ শতাংশ মুসলিম ভোট। বিজেপি যে হিন্দুত্ববাদী লাইনে পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে নেমে পড়েছে, তাতে মুসলিম ভোট নিজেদের দিকে জড়ো করা ছাড়া তৃণমূলের আর কোনো উপায় নেই। এমআইএম-এর মতো দল কোনো কোনো অঞ্চলে শক্তিশালী প্রার্থী দিলে তৃণমূলের সেই ভোট ব্যাঙ্কে টান পড়বে। বিহারে সেটাই ঘটেছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে তা নিয়ে তৃণমূলের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, এমআইএম নেতারা এমনি এমনি তৃণমূলে যোগ দেননি। পুরস্কার হিসেবে দুই একটি জায়গাতে তাঁরা নিশ্চয় প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাবেন। তৃণমূলও সেখানে এক ঢিলে দুই পাখি মারবে। এমআইএম-এর পরিচিত নেতাকে এলাকায় দাঁড় করিয়ে মুসলিম ভোট ঘরে তোলার চেষ্টা করবে।
রাজ্য বিজেপিরপ্রথম সারির এক নেতাও একান্ত আলাপচারিতায় সাংবাদিকের কাছে কবুল করেছেন, তৃণমূল ভালো চাল চেলেছে। মুসলিম ভোট ভাগ করার যে ভাবনা তাদের ছিল, আপাতত তা খানিকটা বাধা পেল। দুর্জনেরা বলেন, এমআইএম-এর সঙ্গে বিজেপির অদৃশ্য গাঁটছড়া আছে। মেরুকরণের ভোট করতে এমআইএম কে বিজেপি ব্যবহার করে। যদিও প্রকাশ্যে কোনো দলই তা স্বীকার করে না।
তবু একটি আশঙ্কা থেকেই যায়। বিজেপির দেখানো পথে তৃণমূল যত ধর্মীয় মেরুকরণের পথে যাবে, ততই ধর্মনিরপেক্ষ ভোটের বড় অংশ তাদের থেকে সরে যাবে। সে ভোট নোটায় পড়তে পারে, অথবা বাম কিংবা কংগ্রেসে ভাগ হয়ে যেতে পারে। বিজেপির কিন্তু সে ভয় নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিজেপি কখনোই উদ্বিগ্ন হয়নি। মেরুকরণই তাদের অস্ত্র। ফলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির যে ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি হয়ে আছে, তা একপ্রকার অটুটই থাকছে। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মুসলিম ভোটের মধ্যে কঠিন ভারসাম্য যদি তৃণমূল তৈরি করতে না পারে, তা হলে তাদের বিপদ কাটবে বলে মনে হয় না।