‘ফাইনালের দল' নাকি ‘সেমিফাইনালের দল'?
১৩ জুলাই ২০১৯বিশ্বসেরা আসরে এক দল সেমিফাইনালে গিয়ে হারবে, অন্য দল ফাইনালে৷ এই যেন তাঁদের ক্রিকেট নিয়তি৷
রবিবার লর্ডসের ফাইনাল তাই ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের জন্য নিজেদের ক্রিকেট পরিচয় নতুন করে লেখার উপলক্ষ্য৷ প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি দুই দলেরই সামনে৷ আর ক্রিকেটবিশ্বও তো ১৯৯৬ সালের শ্রীলঙ্কার পর পেতে যাচ্ছে আনকোরা চ্যাম্পিয়ন৷ হয় ইংল্যান্ড, নয় নিউজিল্যান্ড৷
কিউইদের গায়ে ‘সেমিফাইনালের দল'-এর তকমা এমনি এমনি লাগেনি৷ ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপেই শেষ চারে জায়গা করে নেয় তাঁরা, চার বছর পরও৷ ১৯৮৩ ও ১৯৮৭ আসরে পারেনি, তবে ১৯৯২ টুর্নামেন্টে প্রবল দাপটে পেরেছে আবার৷ এরপর ১৯৯৯, ২০০৭ ও ২০১১ সালে আরো তিনবার৷ অর্থাৎ বিশ্বকাপের প্রথম ১০ আসরের মধ্যে ছয়বারই সেমিফাইনাল খেলে নিউজিল্যান্ড, এবং হারে প্রত্যেকটিতেই৷
২০১৫ সালে অবশেষে সপ্তম চেষ্টায় আনন্দের সপ্তমস্বর্গে কিউইরা৷ ওঠে ফাইনালে৷ কিন্তু হাসতে পারেনি শেষ হাসি৷ অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে রানার্সআপ ট্রফিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়ে তাঁদের৷ এবার শিরোপার শেষ মহারণে টানা দ্বিতীয়বারের মতো৷ এবারও যদি হেরে যায়, তাহলে ‘সেমিফাইনালের দল' নিউজিল্যান্ড একধাপ এগিয়ে ‘ফাইনালের দল' হিসেবে চিত্রিত হবে বড়জোর৷ সেটি নিশ্চিতভাবেই চায় না কেন উইলিয়ামসনের দল৷ পূর্বসুরীদের দায়মোচনে সুযোগটাও লর্ডসে হাতছাড়া করতে চাইবেন না কিছুতেই৷
দায় তো ইংল্যান্ডেরও কম নয়৷ ক্রিকেট খেলাটির আবিষ্কারক তাঁরা৷ প্রথম পাঁচ বিশ্বকাপের মধ্যে তিন-তিনবার ফাইনালও খেলেছে৷ অথচ ১৯৭৯, ১৯৮৭ ও ১৯৯২ সালের প্রতিটি চূড়ান্ত লড়াইয়ে পরাজিত ইংল্যান্ড৷ এ কারণেই তো তাঁরা ‘ফাইনালের দল'; চ্যাম্পিয়ন দল নয়৷
শুরুর পাঁচের মধ্যে ১৯৭৫ ও ১৯৮৩ সালের অন্য দুই বিশ্বকাপেও সেমিফাইনাল পর্যন্ত ওঠে ইংল্যান্ড৷ অথচ কী আশ্চর্য জানেন? প্রথম পাঁচ বিশ্বকাপে তিনবার ফাইনাল ও দুবার সেমি খেলা দলটি পরের ছয় আসরে কোনোবার শেষ চারে নাম লেখাতে পারেনি পর্যন্ত!
এবার তাই ইতিহাসের সব অপ্রাপ্তি ঘুচিয়ে দেবার সুযোগ ইংল্যান্ডের সামনে৷ সব হাহাকারকে জয়ধ্বনিতে রূপান্তরের উপলক্ষ্য৷ এইউন মরগানের দল কি তা হেলায় হারিয়ে বাকি জীবন পস্তাতে চাইবেন!
ইংল্যান্ডের ফাইনাল পর্যন্ত উঠে আসায় চমক নেই তেমন৷ ২০১৫ আসরে বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে যায়৷ এরপর সীমিত ওভারের ক্রিকেটের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দলটি৷ যেকোনো খেলায় ‘ব্যাকরণ' মেনে এগুনোর চর্চা ঝেড়ে ভিন্ন চিন্তায় এগোয় তাঁরা৷ আগ্রাসী ক্রিকেটে; আক্রমণাত্মক ক্রিকেটে৷
চার বছর ধরেই রোমাঞ্চকর ক্রিকেট উপহার দিচ্ছে তাঁরা৷ শুধু ক্রিকেট কেন, ইংল্যান্ডের অন্য কোনো খেলার অন্য কোনো জাতীয় দল কখনো ব্যাকরণের বাইরের খেলা দিয়ে এমন রোমাঞ্চ দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ!
বিশ্বকাপ শুরুর আগেই তাই ‘হট ফেভারিট'-এর সিংহাসনে ইংল্যান্ড৷ টুর্নামেন্টের শুরুটাও দাপটে; পাকিস্তানের কাছে দ্বিতীয় ম্যাচে হার ধরা হচ্ছিল ছোট্ট হোঁচট হিসেবে৷ কিন্তু পরের দিকে শ্রীলঙ্কা-অস্ট্রেলিয়ার কাছে টানা দুই হারে স্বাগতিকদের সেমিফাইনাল খেলাই পড়ে যায় সংশয়ে৷ ভারত ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দাপুটে দুই জয়ে তা উড়িয়ে দেয় মরগানের দল৷
এরপর সেমিতে আক্ষরিক অর্থেই উড়িয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে৷ সেই অস্ট্রেলিয়া, যারা এর আগে বিশ্বকাপের সাত সেমিফাইনাল খেলে জিতেছে প্রত্যেকটিতে৷ সেই অস্ট্রেলিয়া, যাঁরা এ বিশ্বকাপের লিগ পর্বেও ইংল্যান্ডকে হারায় ৬৪ রানে৷ সেমিফাইনালে অ্যারন ফিঞ্চের সে দলকে ২২৩ রানে অলআউট করে, ১০৭ বল ও আট উইকেট হাতে রেখে জিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের আগাম ঘোষণাই যেন দেয় ইংল্যান্ড৷
কিন্তু নিউজিল্যান্ডও কি ছেড়ে কথা বলার দল! বিশেষত ট্রফি জয়ের আরেক ফেভারিট ভারতকে সেমিফাইনালে হারানোর পর! বিশ্বকাপের প্রথম ছয় ম্যাচের মধ্যে পাঁচ জয় এবং বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া খেলার এক পয়েন্ট নিয়ে শুরুটা দারুণভাবে করে কিউইরা৷ লিগ পর্বে শেষ তিন ম্যাচ হারলেও তাই সেমিফাইনালে নাম লেখানোয় সমস্যা হয়নি৷ সেখানে ভারতের ফেভারিট-দর্প চূর্ণ করে ওঠে ফাইনালে৷ প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপার সঙ্গে এক ম্যাচ দূরত্বে তাই নিউজিল্যান্ড৷
সে ‘প্রথম'-এর প্রতীক্ষায় ইংল্যান্ডও৷ এর মধুর সমাপ্তির জন্য তাঁরা চাইবে ফাইনালে বেয়ারস্টো-রয়-বাটলার-স্টোকসের ব্যাটের তুফান, জো রুট-এউইন মরগানদের নির্ভরতা, আর্চার-উডদের বলে আগুনে গোলা, আদিল রশিদের মায়াবী স্পেল৷ অন্তহীন অপেক্ষার অবসানে বিশ্বকাপ ট্রফিতে স্পর্শের জন্য নিউজিল্যান্ডের চাওয়া গাপটিলের শেষবেলায় জ্বলে ওঠা, উইলিয়ামসন-টেলরের জ্বলন্ত রানমশাল না নেভা এবং আরো বেশি করে বোল্ট-ফার্গুসন-হেনরি-নিশাদের গতির ঝড়৷
হয় অপেক্ষার অবসান হবে কিংবা প্রতীক্ষার৷ যুগ-যুগান্তরের আক্ষেপ ফুরাবে হয়তো ‘ফাইনালের দল', নয়তো ‘সেমিফাইনালের দল'-এর৷ আর এমন মাহেন্দ্রক্ষণের মঞ্চ হিসেবে লর্ডসের চেয়ে উপযুক্ত হতে পারত কোন ভেন্যু!