প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা মেয়েগুলো কৈশর কেটেছে ক্ষুধা ও অভাবের জ্বালায়। দারিদ্রটা মানুষের গৌরব নয়, গ্লানি। অভাবের জ্বালায় সেই মানুষ যখন রুখে দাঁড়ায়, তার অর্থ এই নয় যে, সারা দুনিয়াকে সে ছারখার করে দেবে। সে চেনা পথের বাইরে গিয়ে সব হাহাকার উড়িয়ে নিজেকে সাজাবে। মেয়েদের এই জীবন সাজানোর পথটাই দেখিয়েছে ফুটবল। তারপর ফুটবলকে আলিঙ্গন করে তারা মেতেছে সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে। নিজেরা বড় হয়েছে, সঙ্গে নারী ফুটবলের চারগাছটিও এখন পরিণত কৃষ্ণচূড়ার রঙে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ এশিয় ফুটবলে।
এই অঞ্চলে বরাবরই আধিপত্য ছিল ভারতের। যাদের বিপক্ষে আগে গোল মিছিলের ভয়ে থাকতো, এখন তাদেরকে হারিয়ে বাংলাদেশ নিজেদের প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে নারী সাফ ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসনখানি নবায়ন করে নিয়েছে। চারদিকে ধন্য ধন্য রব উঠছে। মনিকা-ঋতুপর্ণা-সাবিনাদের স্তুতি হচ্ছে।
একবার ভাবুন, সেই দারিদ্রের কষাঘাত ও ফুটবল না থাকলে আজ দক্ষিণ এশিয় ফুটবলে লাল-সবুজের গৌরবের পতাকা উড়ে না। কলসিন্দুর গ্রামের ফুটবল উপাখ্যান রচিত হয় না, কিংবা পরে তার মডেলে সারা দেশে মেয়ে ফুটবলের বিপ্লব হয় না।
বিপ্লবই যখন বলছি তখন অবশ্যই ফিরতে হবে ২০০৪ সালে। যখন প্রবল ধর্মীয় গোড়ামি ও সামাজিক বাধার মুখে পড়েছিল মেয়েদের ফুটবল। ফিফা বারবার চাপ দিচ্ছিল মেয়েদের খেলা চালু করার জন্য। তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ৬টা দল নিয়ে কোনরকমে মেয়েদের ফুটবল শুরুর উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। কিন্তু শুরুর দু-একদিন আগে শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পর
মৌলবাদীরা এর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে। মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারবে না। তারা ফুটবল ফেডারেশন ও কমলাপুরে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম ঘেরাও করার ডাক দেয়। তখন টুর্নামেন্ট কমিটির প্রধান কামরুন নাহার ডানার আহবানে বিভিন্ন নারী মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। পাশাপাশি সরকার তৎপর হয় এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় মৌলবাদের চোখ-রাঙানি ও সামাজিক বাধা অতিক্রম করে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে গড়ায় মেয়েদের ফুটবল।
এখনো চলছে অস্তিত্বের লড়াই
এটা স্পষ্ট যে, সেই ২০০৪ সালে মেয়েদের ফুটবল প্রশ্নে ভয়াবহ বিপজ্জনক ছিল এই জনপদ! দুই দশক বাদে সেখানকার মানুষই মাথায় তুলে নাচছে ফুটবলের মেয়েদের। ছাদখোলা বাসে তাদের অভিনন্দন জানাতে রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষা করছে। মেয়ে মানুষের ফুটবল খেলা নিয়ে যাদের মনে অন্য চিন্তা ছিল, তারাও সেখান থেকে সরে এসে সাবিনাদের সাফল্যের অংশীদার হয়েছে, শিরোপা উদযাপন করেছে।
কিন্তু এবার শিরোপা জয়ের পর অধিনায়ক সাবিনা খাতুন যে বেশ কঠিন গলায় বলেছেন, "এটা ছিল আমাদের অস্তিত্বের লড়াই।” এটার প্রেক্ষাপট আসলে ভিন্ন। তার মতো আরো কয়েকজন সিনিয়রকে বাদ দেওয়ার পায়ঁতারা হয়েছিল কাঠমান্ডুতে। দৃশ্যত ছকটা কষেছিলেন ইংলিশ কোচ পিটার বাটলারই, হয়তো-বা বাফুফের মহিলা কমিটির কারো ইন্ধনও ছিল। সিনিয়ররা দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হয়, ট্রেনিং বয়কট করে বলেই তাদের ওপর মনক্ষুন্ন কর্তারা। জুনিয়রদের খেলিয়ে শিরোপা জিতলে এক সঙ্গে দুটো কার্যসিদ্ধি হয়। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই চেষ্টা বিফলে গেলে দলে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং সিনিয়ররা রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
এরপর দলের হাল ধরেন সিনিয়ররা। একে একে শক্তিশালী ভারত ও নেপালকে হারিয়ে মারিয়া-মনিকা-সাবিনারা প্রমাণ করেন নিজেদের সামর্থ্য। মানুষের জীবনে লড়াই কখনো থামে না। জীবন তাদের এমন সব বাঁকে নিয়ে দাঁড় করায়, সেখানে আবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেখাতে হয়। এখন সাবিনাদের সাফ উত্তীর্ণের উদযাপন চলছে দেশে।
স্কুল টুর্নামেন্টই নারী ফুটবলের আতুঁড়ঘর :
ওই ২০০৪ সালে শুরুর পরও মেয়েদের ফুটবলে তেমন অগ্রগতি ছিল না। আটপৌরে নারীর হাঁটা ফুটবল ছিল। তারা দৌঁড়াতে শুরু করে ২০১১ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ শুরুর পর থেকে। স্কুল ছাত্রীদের নিয়ে শুরু এই ফুটবল টুর্নামেন্টে প্রায় ৬০ হাজার স্কুল অংশগ্রহণ করে। প্রতি বছর স্কুলের সংখ্যা বাড়ে, বাড়ে খুদে ফুটবলারের সংখ্যা। শুরুর সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট টেনে কলসিন্দুর স্কুলের সাবেক শিক্ষক মফিজ উদ্দিন বলেছেন প্রতিবন্ধকতা জয়ের কাহিনী, "ওই সময় সরকার মেয়েদের ফুটবল দল তৈরির চাপ দিয়েছিল। কিন্তু স্কুলের মেয়েদের মাঠে নামানো খুব কঠিন। মুসলিম মেয়েদের খেলার অনুমতি নেই ঘর থেকে। কয়েকজন উপজাতি মেয়ে নিয়ে আমি ফুটবল প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম। এরপর আস্তে আস্তে মুসলিম মেয়েরাও মাঠে আসতে শুরু করে। এজন্য টুর্নামেন্ট শুরুর প্রথম দুই বছর আমরা ভাল করতে পারিনি।” সামাজিক কূপমন্ডুকতার অর্গল ভেঙ্গে এলাকার মেয়েরা যখন ফুটবলে ছুটল তখন ময়মনসিংহের কলসিন্দুর হয়ে ওঠে নারী ফুটবল জাগরণের উর্বরা ভূমি। তিনবারের চ্যাম্পিয়ন স্কুলটিই হয়ে ওঠে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে বাকি দলগুলোর অনুপ্রেরণা। পরে তাদের পথে হেঁটেছে অনেক স্কুল।
স্কুলগুলোর লড়াইয়ে মেয়ে ফুটবল এত চমৎকার পল্লবিত হয়েছে তার ফল মেলে ২০১৫ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৫ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে। স্কুলের মেয়েরা আলোর মশাল হাতে বিদেশ-বিভুঁইয়ে খেলে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে এদেশের নারী ফুটবলের অন্ধকার যুগ অবসানের বার্তা দিয়ে ফেরে। সাফল্যের ধারা বজায় থাকে অন্যান্য বয়সভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্টেও। তারই পরম্পরায় বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয় নারী ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে।
তাই বলি, এই বঙ্গমাতা ফুটবলই দেশের নারী ফুটবলের অক্সিজেন। খেলার ভাষায় বললে, নতুন ফুটবলার ওঠে আসার পাইপ-লাইন। ‘বঙ্গমাতার' নামে রাগ-অনুরাগ যাই থাকুক, অন্তত এই স্কুল টুর্নামেন্টটা বেঁচে থাকলে প্রতিভার আকাল পড়বে না। নারী ফুটবলের সুশ্রী, সুবেশ চেহারাটাও আকর্ষন হারাবে না।
চোখ রাখতে হবে এশিয় মানে
তবে আভিজাত্য যোগ করতে হলে ফুটবল ফেডারেশনের চলন-বলন এবং দৃষ্টিভঙ্গিসহ অনেক কিছুই বদলাতে হবে। বিশেষ করে ফুটবলে আশ্রিত
মেয়েগুলোর জীবনের মাধুর্যটা যেন হারিয়ে না যাায়। তাদের কল্পনার পেখমগুলো যেন গুটিয়ে নিতে না হয়। ২০২২ সাফ শিরোপার অন্যতম কারিগর সিরাত জাহান স্বপ্না যেমন ফুটবলের স্বপ্ন ভুলে সংসারে মনযোগী হয়েছেন। এর পেছনে বড় কারণ হতাশা, "আমার খেলা ছাড়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমটা হলো ভারতে লিগ খেলার প্রস্তাব পেয়েও যেত পারলাম না। তারপর দেশে মেয়েদের ফুটবল খেলা অনেক কমে যাচ্ছিল, একটা খেলার পর অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়। ঘরোয়া লিগ নিয়েও অনেক অনিশ্চয়তা। নারী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের ঘোষণা দেওয়ার পরও হয়নি।” টাকা-পয়সার হিসাবে গিয়ে তিনি দেখেন ব্যাপক গড়মিল, "ছেলেদের বেলায় দেখা যায় ৭-৮ বছর খেললে একটা বড় অঙ্কের অর্থ জমা হয়, মেয়েদের বেলায় তার কানাকড়িও নেই। মেয়েরা যেসব সাফল্য এনেছে সেই তুলনায় কিছুই পায় না।”
সিরাজ জাহান স্বপ্নাদের চাওয়া অনেক বেশি ছিল না। ছেলেদের ফুটবলে কাড়ি কাড়ি টাকা বিনিয়োগ করেও কিছু পাওয়া যায় না। আর মেয়েরা বেতন বকেয়া রেখে ফেরে শিরোপার গৌরব নিয়ে। একটু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই মেয়েদের আস্থা অর্জন করা যায়। তাদের চোখে আরো বড় স্বপ্ন এঁকে দেওয়া যায়। নারী ফুটবলকে এশিয় মানে উন্নীত করার স্বপ্ন। টানা দুবার সাফ জয়ী দলকে সামনে এগিয়ে নিতে গেলে নতুন লক্ষ্য স্থির করতে হবে। লক্ষ্য বড় হলে সাফ আরো সহজ হয়ে যাবে। এজন্য তাদের সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে দেওয়ার কাজটা করতে হবে ফুটবল ফেডারেশনকে।
অবকাঠামো উন্নয়ন খুব জরুরি
ফুটবলকে ঘিরে মেয়েদের জীবন-মান উন্নয়নের মডেল দাঁড় করানোর জন্য একটা প্রতিদ্বিন্ধিতাপূর্ণ লিগ খুব জরুরি। যে লিগ হয় তার কোনো কাঠামোই দাঁড়ায়নি। দল খুঁজে পাওয়া যায় না। মহিলা ফুটবল কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ নিজ উদ্যোগে ভিন্ন ভিন্ন নামে দল নামিয়ে দেয় মাঠে। তারা ভিন্ন নামে খেলে, থাকে বাফুফে ভবনের ডরমেটরিতে, ট্রেনিংও করান বাফুফের কোচরা। এ এক উদ্ভট লিগ!
এক কোচ মজা করে বলেছিলেন, "এটার নাম কিরণ-মানিক লিগ হলে ভাল হতো। কিরণ আপাই একটা দলের মালিক,তার সঙ্গে লড়াই হয় মানিক ভাইয়ে দলের।
দুজনই কোনো ফুটবলারকে তেমন টাকা-পয়সা দেয় না।” এতদিন সাবেক বাফুফে সহ সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিকের একটা দল ছিল। নতুন কমিটিতে তিনি নেই, তাই তার দল নিয়েও সংশয় আছে।
দুর্ভাগ্য হলো, মেয়েদের ভাল পারিশ্রমিক দিয়ে খেলা পেশাদার বসুন্ধরা কিংস এবার অংশ নেয়নি মেয়েদের লিগে। হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও তারা খেলেনি। এজন্য দায়ী এক বাফুফে কর্তার। তার হীনমন্যতার শিকার হয়ে এই চ্যাম্পিয়ন দলটি এএফসি নারী চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ভারত, নেপাল, ভুটানের ক্লাব দল খেললেও সাফজয়ী দেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই এএফসির এই টুর্নামেন্টে। এটা মোটেও ভাল উদাহরণ নয়। স্থানীয় লিগে কিংস থাকলে দুই জায়ান্ট আবাহনী-মোহামেডানের ওপরও নৈতিক চাপ তৈরি হতো মেয়েদের লিগ খেলার জন্য। এখন সেটাও নেই। বাস্তবতা হলো, এই দলগুলোকে বাদ দিয়ে মেয়েদের লিগের কাঠামো শক্তিশালী করা যাবে না। নতুন বাফুফে সভাপতি তাদের মাঠে ফেরাতে পারলে মেয়েদের ফুটবল উন্নয়নে একটা বড় পদক্ষেপ হবে।
অবকাঠামোর মধ্যে পড়ে বাফুফে ডরমেটরি নামের ‘ফুটবল বস্তিটি'ও। এখানে ৫০ থেকে ৬০ জন বা তারও বেশি ফুটবলারের বাস। ১১টা রুমের একেকটিতে ৬/৭ জন করে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেও অপ্রতুল টয়লেটে লাইন দিতে হয়। সাফ বিজয়িনীদের বস্তির জীবনের গল্প বাইরে বলারও স্বাধীনতা নেই। রোজ রোজ রুই-পাবদা খাওয়ার অনিচ্ছাটুকুও প্রকাশের সুযোগ নেই। উত্তর কোরিয়ার কোনো এক বন্দিশালার মতো, যেখানে মেয়ে ফুটবলারদের জীবনে উল্লাস ও সুখের গভীরতা নেই। অথচ নারী ফুটবল উন্নয়নের জন্য ফিফা কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে প্রতি বছর। এরপরও বস্তিতে আটকে আছে মেয়েদের ফুটবল !
এখন ক্ষমতার পালা বদলের সময় বলে হয়তো সাবিনারা ক্ষনিকের বাক স্বাধীনতা ভোগ করছেন। উগড়ে দিচ্ছেন ‘ফুটবল বস্তি'র অন্দরমহলের অস্বস্তি ও অস্বাস্থ্যকর দিনযাপনের অভিজ্ঞতা। কথাগুলো যেন নতুন বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালের কানে পৌঁছে। এবং তিনি সহৃদয়ে যেন অস্বস্তিগুলো অনুভব করেন।
সাফ বিজয়িনীদের সামনে এগোনোর রাস্তাটা তাকেই করে দিতে হবে। বাইরে তাদের প্রশংসায় ভাসিয়ে ভেতরে ‘সদরঘাট' করে রাখলে কোনো লাভ নেই। চালাকি দিয়ে মহৎ কাজ হয় না। নারী ফুটবলের স্বপ্ন আটকা পড়বে সংকীর্ণতায়। ঠিক যেভাবে আটকে গেছে ছেলেদের ফুটবল। প্রকৃতিই যে এর প্রতিশোধ নিয়ে নেয়।