1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এক্সপোজড-এ ডিজপোজড ‘ভিকটিম'

ফাতেমা আবেদীন
৬ জানুয়ারি ২০২৩

ভিকটিম শব্দটার একটি যথাযথ বাংলা খুঁজে পাওয়া দুরূহ৷ আইন-আদলতের মামলায় গড়ালে ভিকটিম কখনো বাদি পক্ষ হয়ে যান, কখনো বিবাদি৷

https://p.dw.com/p/4LpP2
২০২২ সালে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন ৬৪ শতাংশ নারী৷
২০২২ সালে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন ৬৪ শতাংশ নারী৷ছবি: Jaap Arriens/NurPhoto/picture alliance

আদালত বা থানায় বা পুলিশি খাতায় ‘ভিকটিম' নামেই পরিচিত থাকেন৷ আপাত ভাষায় ভিকটিমকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত' বলে দাবি করা গেলেও আসলে সেই ক্ষয়-ক্ষতির খতিয়ান যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ বুঝতেও পারবো না ভিকটিমের যাতনা৷

- ধান ভানতে শিবের গীত কেন গাইছি প্রশ্ন করতে পারেন৷ যেহেতু ‘এক্সপোজড' শব্দটি তুলে এনেছি শিরোনামে, সহী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা নির্দ্বিধায় বুঝে গেছেন কি নিয়ে আলাপ করতে যাচ্ছি৷

‘এক্সপোজড' খুবই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ৷ তাই শুরুতেই অভিধান খুলে বসেছি৷ যে কফি প্রস্তাবের কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক্সপোজড শব্দটির বহুল চর্চা হয়েছে সেই আলাপটা আর তুলতে চাইছি না বলেও তুলতে হচ্ছে৷ ডেটিং অ্যাপের মতো সোশ্যাল সাইটে কেউ কাউকে কফির প্রস্তাব দিতেই পারে৷ তাতে হালকার ওপর ঝাপসা রসিকতাও বোধহয় সমর্থন করেন হালের অ্যাপ ব্যবহারকারী সোশ্যাল মিডিয়াবান্ধব জনগণ৷ আমার ব্যক্তিগতভাবে এইসব অ্যাপ বিষয়ক ধারণা নেই, তাই জানি না কতটুকু পর্যন্ত সীমা আছে রঙ্গ-রসিকতার৷ তবে ডেটিং অ্যাপ নিয়ে হালকা জানাশোনা ছিল৷ সেখানে যে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা সক্রিয়, এটুকু জেনেই একটু আতঙ্কিত হয়েছি৷ আমাকে আবার সেকেলে ভেবে বসবেন না৷ তারুণ্যে যখন দাপিয়ে বেড়ানোর কথা, পাড়ার গলি-ঘুপচি মাতিয়ে রাখার কথা সেই বয়সে কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে সঙ্গী খুঁজছেন আপনি৷ এর পেছনে কতটা নিঃসঙ্গতা বা কতটা ‘ডিপ্রেশনের' গল্প অজানা রয়ে গেছে আমাদের- সেই বোধ থেকে আতঙ্কিত হলাম৷ উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি মানেই আড্ডা, নতুন নতুন পরিকল্পনা করা, পথে-ঘাটে দাপিয়ে বেড়ানো৷ প্রযুক্তি আপনাকে নিঃসন্দেহে এগিয়ে নেবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধুম মাচাবেন নিশ্চয়৷ কিন্তু বুঁদ হয়ে থাকাটাকেই একটু নেতিবাচক চোখেই দেখছি৷

এখন আসুন কফি খাওয়ার রসিকতায় ফিরি৷ সেই রসিকতাকে পুঁজি করে আপনি নিজেকে ভিকটিম দাবি করে ভিন্ন একটি মাধ্যম ব্যবহার করে যখন একজন সুপরিচিত ব্যক্তির ‘কুরুচিপূর্ণ' মুখোশ উন্মোচনের দাবি করবেন, তখন আলাপ তুলতেই হবে৷ না তুলে পারা যাবে না৷

কয়েকটি কারণে তুলতে হবে-এখানে ভিকটিম কতটা হ্যারাস হয়েছেন, কিংবা সুপরিচিত ব্যক্তি কতটা হেয় করেছেন সেই নারীকে সেই বিষয়টি জানা জরুরি৷ ভিকটিমের দেওয়া স্ক্রিনশটের দাবিতে আলাপগুলো নেহায়েত সস্তা রসিকতা মোটামুটি সবার বিবেচনায়৷ এখন ভিকটিম যদি পশ্চিমা সংস্কৃতির দোহাই তুলে ‘কফি ডেট' মানে শয্যাসঙ্গী হওয়ার আহবান দাবি করেন, তবে সেটিও করতে পারেন৷ এখানে পালটা যুক্তি আসবে-ডেটিং অ্যাপে আপনি আসলে কী করতে গিয়েছিলেন? এমন কোনো প্রস্তাব বা কাউকে সঙ্গী হিসেবে পেতেই তো? যদি তাই হয়- তাহলে প্রস্তাব কতটুকু অনৈতিক সেটি নিয়ে আলাপ চলতে পারে৷

এখন সব ছাপিয়ে মূল বিষয় হয়ে গেছে মিডিয়া ট্রায়াল৷ সোশ্যাল মিডিয়া এখন দুই ভাগ৷ একভাগ ভিকটিমের পক্ষে, আরেকভাগ অভিযুক্তের পক্ষে৷ ভিকটিমের পক্ষের লোকেরা অভিযুক্তের পরিচিত তুলে ধরে তার পরিবার, তার দেশখ্যাত বাবার চরিত্রে পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন, চলছে পোস্টমর্টেম৷ বাবা কেমন ছিলেন, মা কেমন, বোনেদের ঠিকুজি-কুষ্ঠি কিচ্ছু বাদ পড়েনি৷ এদেশে নয় টাকায় এক জিবি ইন্টারনেট আর ৯৯৯ টাকায় টাচফোনের বদৌলতে সবই সম্ভব৷ আমরা নিজেদের সীমাটা বরাবরই ভুলে যাই৷ উপযাচক হওয়ার ইচ্ছাটা অবদমন করা যায় না৷

অন্যদিকে অভিযুক্তের পক্ষের লোকেদের পাল্লা একটু ভারি৷ মোটামুটি বিবেচক লোকেরাই দাবি করছেন ডেটিং অ্যাপে এসব সস্তা রসিকতা চলতেই পারে৷ এটাকে এত ভারি করে তোলার কোনো মানে হয় না...এই নিয়ে কম ট্রলড (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হালকা রসিকতাপূর্ণ হয়রানির অপর নাম) হতে হয়নি দাবিকৃত ভিকটিমকে৷ তার আর অভিযুক্তের পক্ষ নিতে গিয়ে আমরাই সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করে অপরাধী হয়ে উঠছি দুই পক্ষ নিয়েই তামশা করার মাধ্যমে৷

এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই৷ সাইবার বুলিং বা হ্যারাসমেন্ট শব্দটির সঙ্গে নিশ্চয় আপনাদের পরিচয় আছে? গত এক বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন ৬৪ শতাংশ নারী৷ কোন ৬৪ শতাংশ সেটি জানলে চমকে উঠবেন৷ মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ নন৷

ফাতেমা আবেদীন, সাংবাদিক
ফাতেমা আবেদীন, সাংবাদিকছবি: privat

অ্যাকশন অ্যাইড পরিচালিত গবেষণার জন্য যে জরিপ করা হয়, তাতে ১১ থেকে ১৮ নভেম্বর ৫১৪ অনলাইন ব্যবহারকারী নারী অংশ নেন৷ এর মধ্যে ৩৫৯ জন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন৷ এ ছাড়া এ বিষয়ে ছয় জেলায় ছয়টি দলগত আলোচনায় গ্রামীণ অঞ্চল থেকে অংশ নিয়েছেন কিশোরী ও নারীরা৷ অর্থাৎ গবেষণায় অংশ গ্রহণকারী নারীদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ বুলিং বা হ্যারাসমেন্টের শিকার৷ মানে হিসাবের সংখ্যাটা ভীষণ কম৷ প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয় কোনো বিচার হবে না বা প্রতিকার পাওয়া যাবে না এই ভিত্তিতে ৮৫ শতাংশ নারী অভিযোগই করেন না৷

অনলাইনের খণ্ডচিত্র তো দেখলেন৷ অফলাইনের গল্পটা জানেন কি? জেন্ডার প্লাটফর্ম বাংলাদেশ তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২২ সালের প্রথম ১০ মাসে তিন হাজার ৬৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ শুধু অক্টোবর মাসেই কন্যাশিশুসহ ৩৭১ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৯১ জন, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে দুজন৷ এ সময় নারী ও কন্যাশিশু পাচারের ঘটনা ঘটেছে ৬৩টি৷ আইন সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৯৩৬ নারী৷

জেন্ডার প্লাটফর্ম বাংলাদেশ বা আইন সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনের ভিত্তি কেবলমাত্র থানায় দায়ের করা জিডি বা মামলা এবং সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য৷ এর বাইরে রয়েছে অভিযোগ না করা ৮৫ শতাংশ নারী৷ কত নির্যাতন কত বুলিংয়ের গল্প আপনার আমার সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়াল পর্যন্ত আসে না সে বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই আমাদের৷ আমরা এক্সপোজডের গল্পতেই হাসি-ঠাট্টা ও বিচার বিবেচনাবোধ শেষ করে ফেলছি৷

তাই আপনারা সমাজের সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্তরা (ধরে নিচ্ছি) যখন এক্সপোজড করার সুযোগ নিচ্ছেন তখন ৮৫ শতাংশ নারীর নির্যাতনের গল্পগুলো ডিসপোজড হয়ে যায়৷ বিচার দিয়ে কী হবে, কাকে কোথায় প্রকাশ্যে আনলে কতটুকু সুবিধা বিচার পাওয়া যাবে সেই ধারণাই নেই সেইসব মানুষের৷

তাই বলি কী- আপনাদের কালচার বা সংস্কৃতিতে এমন চর্চা না আসুক যাতে করে সত্যিকারের এক্সপোজড হওয়ার মতো ঘটনাগুলো মানুষের অগোচরেই থেকে যায়৷ সত্যিকারের ভিকটিম ও তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো রীতিমতো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে নিত্য৷ আমরা আরেকটু পরিশীলিত হই অনলাইন ব্যবহারে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামাজিক হই৷ আমাদের বালখিল্যতায় যেন বিচারের বাণী নিভৃতে না কাঁদে৷ নতুন বছরে এইটুকু প্রতিজ্ঞা ও প্রচেষ্টা হয়তো অনেকের জন্য অনেক পথ সহজ করে দেবে...

Fatema Abedin, Intern, DW Bangla section.
ফাতেমা আবেদীন বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও সাংবাদিক