একের পর এক বিস্ফোরণ: দায় কার?
২ জুলাই ২০২১বছর দুয়েক আগের কথা৷ ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের ফরম পূরণ করতে যেয়ে গলদঘর্ম হচ্ছি৷ এত বছরের জীবনে এত জটিল ফরম আর দেখিনি৷ সবকিছুই ঠিকঠাক, তারপরও এই ফরম পূরণ করা রীতিমত একটা পরীক্ষা৷ আগে এই কাজটা আয়কর আইনজীবী করে দিত৷ আয়-ব্যয়ের সব কাগজপত্র তাকে দিয়ে আসতাম, তিনি আমার হয়ে রিটার্ন জমা দিয়ে দিতেন৷ বিনিময়ে তাকে একটা ফি দিতে হতো৷ কিন্তু সরকার আয়কর মেলা চালুর পর যখন শুনি অনেকেই নিজের রিটার্ন নিজেই জমা করছেন, তখন একবার ভাবলাম- আমিই বা বাদ থাকি কেন৷ নিজের রিটার্ন নিজেই জমা দেব৷ বন্ধু-বান্ধবের কেউ কেউ সাবধান করে বলল, বিষয়টি অত সহজ নয়৷ ফরম পূরণ করাই বেশ জটিল৷ বাস্তবে রিটার্নের সেই ফরম পূরণ করতে যেয়ে টের পেলাম বিষয়টা কতটা জটিল৷ তবে থমকে যাইনি, প্রতিবারই হাবুডুবু খেয়েছি, কিন্তু নিজের রিটার্ন ফরম নিজেই পূরণ করেছি৷ সেবারও তাই হচ্ছিল৷ পুরো বাসা টের পাচ্ছিল- আমি কোন একটি ‘বিশাল' কাজ করছি৷ এই কাগজ খুঁজছি, ওই দলিল হারাচ্ছি৷ একে ওকে ধমকাচ্ছি৷ পুরো বাসা যেন মাথায় তুলে নিয়েছি৷
এরই মধ্যে আমার শিশুপুত্র সাবিব জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, ট্যাক্স কি?'
আমি একটু থমকে গেলাম৷ আমার কর্মকাণ্ড দেখে সেও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি৷ আর এই কাজটির সঙ্গে ‘ট্যাক্স' বিষয়টা জড়িত৷ কিন্তু আমি তাকে ‘ট্যাক্স' কি করে বোঝাই! সে মাত্রই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে৷
আমি আমার মতো করে চেষ্টা করলাম৷ ‘‘এই যে আমরা পাকা রাস্তা দিয়ে চলি, এটা কে বানায়? বড় বড় ফ্লাইওভার তৈরি হয়, কে করে? সরকার তো? কিন্তু সরকার এসব করার জন্য টাকা কোথায় পাবে? সরকার তো আর চাকরি করে না৷ আমরা যারা চাকরি করি, ব্যবসা করি, ইনকাম করি, তারাই সরকারকে একটা টাকা দিই৷ সেই টাকাগুলো জমিয়ে, তা থেকে সরকার এসব করে৷ এই যে পুলিশ দেখছ, এদেরকে কিন্তু আমাদের ওই টাকা থেকেই সরকার রেখেছে৷ পুলিশের কাজ হলো- চোর ডাকাতরা যাতে আমাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে, সেটা দেখা৷ চোর-ডাকাত পেলে তাদেরকে ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া৷''
সাবিব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল৷ মাথা নাড়ল৷ তারপর বলল, ‘‘সরকার কে? শেখ হাসিনা?''
আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম৷ সে চলে গেল৷ আমি মুগ্ধ হলাম, ছেলের প্রতিভায় নাকি নিজের প্রতিভায়- বলা মুশকিল৷ ভাবলাম- যাক, এই ঝামেলার সময় অল্পতেই বুঝ দিতে পেরেছি, আপদ তো বিদায় হলো৷
কিন্তু আপদ যে বিদায় হয়নি, বরং বিপদের মাত্র শুরু হয়েছে বুঝলাম কদিন পরেই৷
সকালে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলাম হেঁটে হেঁটে৷ রাতে বৃষ্টি হয়েছিল৷ স্কুলের কাছাকাছি যেয়ে দেখি ড্রেন উপচে পানি ফুটপাতে উঠে গেছে৷ পা বাঁচিয়ে অনেক কসরৎ করে অগ্রসর হতে হচ্ছে৷ ছেলে বিরক্ত৷ হঠাৎ বলল, ‘‘তুমি শেখ হাসিনাকে বলতে পার না, সে এই ড্রেন ঠিক করে না কেন? আমার জুতা ভিজে গেল!''
এই ধারা চলতে থাকল৷ বাসার সামনে রাস্তা ভাঙা, সুড়কি উঠে গেছে, হাসিনাকে বলতে হবে৷ রাস্তায় জ্যামে আটকে আছি, হাসিনা কী করে? তার পুলিশ তো ঠিক মতো কাজ করে না!
আমি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করি, ‘‘সবকিছুর জন্য কি সরকারকে দায়ী করা যায়? আমরা যদি চিপসের প্যাকেটগুলো ড্রেনের মধ্যে না ফেলি, তাহলেই তো আর ড্রেন বন্ধ হয়ে পানি উপচে ওঠে না৷''
‘‘ড্রেনের মধ্যে চিপসের প্যাকেট ফেলতে না দিলেই হয়৷ পুলিশ আটকায় না কেন?''
আমার স্কুলপড়ুয়া ছেলে, সবকিছুর মধ্যে এভাবেই সরকারের দায়িত্ব খুঁজে পায়, যে-কোনো অঘটনের দায় সরকারকেই দিতে চায়৷
এবার মগবাজারের ঘটনাটি বলি৷ একেবারে প্রধান সড়কের ওপর একটি তিনতলা ভবন৷ গত রবিবার (২৭ জুন, ২০২১) সন্ধ্যায় সেই ভবনের নিচতলায় একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ হলো৷ নিচতলাটি একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল৷ আশপাশের ভবনগুলো কেঁপে ওঠল, অনেক কটি দোকানঘরে আগুন লেগে গেল, ভেঙে চুরমার হয়ে গেল৷ ভবনের সামনে কয়েকটা গাড়ি ছিল, সব বিধ্বস্ত হয়ে গেল৷ তাৎক্ষণিকভাবে মারা গেল ৬ জন৷ অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো অনেকে৷ সেখান থেকে প্রতিদিনই দুজন তিনজন করে মৃত্যুর খবর আসতে থাকল৷ এখনো আসছে৷ ধারণা করা হচ্ছে- এ সংখ্যা আগামী কয়েকদিন বাড়তেই থাকবে৷
এরই মধ্যে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসার কর্তাব্যক্তিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন৷ তারা যে ঘটনাটি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন, সেটাও বোঝা গেছে তাদের কর্মকাণ্ডে৷ এই প্রত্যেকটি বিভাগ একটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ প্রতিটিই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি৷ রিপোর্ট দেওয়ার জন্য কমিটিগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে৷ কিছু সময়সীমা এরই মধ্যে অতিক্রান্তও হয়ে গেছে৷ তদন্তের ফলাফল জনগণ জানতে পেরেছে বলে আমি জানতে পারিনি৷ তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে মাতামাতি অবশ্য অর্থহীন৷ কারণ, এতে তো আর মৃত মানুষগুলো ফিরে আসবে না৷ আবার অন্যভাবে বলতে গেলে- অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু অন্তত বলা যায় যে, দুর্ঘটনার সকল দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের উপরেই পড়বে, কিছুমাত্র দায় সরকারের ওপর যাবে না৷
আগের অভিজ্ঞতাগুলোর দিকে তাকালে আমরা কী দেখি? গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে এরকম বিস্ফোরণ ঘটে৷ মসজিদে তখন লোকজন ছিল, তারা এশার নামাজ পড়ছিল৷ বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়, দগ্ধ হয় আরও ১৫ জন৷ তদন্ত সংস্থা সিআইডি বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটন করে৷ তারা জানায়- মসজিদের ভেতরে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ছিল, ছিল গ্যাসেরও অবৈধ সংযোগ৷ অবৈধ বিদ্যুতের স্পার্ক যেয়ে পড়েছে অবৈধ গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হয়ে আসা গ্যাসের ওপর, আর তাতেই বিস্ফোরণ৷ অর্থাৎ, পুরো দায় মসজিদ কর্তৃপক্ষের৷ তারা বিদ্যুৎ আর গ্যাসের অবৈধ সংযোগ কেন নিল? কিন্তু এ ঘটনায় মারা যারা গেলেন, তারা কি এই অবৈধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত? তারা পবিত্র মনে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন৷ নিহত ৩৪ জনেরই রয়েছে ৩৪টি ইতিহাস৷ মিডিয়াতে তার কিছু কিছু এসেছে৷ পড়তে যেয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে৷ কিন্তু দিন শেষে সেই ‘অবৈধ' এর চক্করে পড়ে গেছি আমরা৷ আচ্ছা, সরকারি কাজে ‘অবৈধ' বিষয়টি ঢুকে কি করে? বিদ্যুৎ বা গ্যাস সংযোগ বৈধ কি অবৈধ, তা দেখার জন্য সরকার লোক কি নেই? তারা যে বিষয়টি দেখলেন না, উলটা অবৈধ আয়কে অব্যাহত রাখতে অবৈধ সংযোগকেই উৎসাহ দিতে থাকলেন বা সবসময়ই দিতে থাকেন, তার কি কোন বিচার হবে না? সরকারের নিয়োগকৃত ব্যক্তির দায় কি শেষ বিচারে যেয়ে সরকারের ওপরই বর্তায় না? এই জন্যই কি, সরকারের তদন্ত কমিটিগুলোর রিপোর্টে জনগণকেই দায়ি করতে দেখা যায় বেশি?
আমরা এরও আগের বেশ কিছু মর্মান্তিক ঘটনার দিকে তাকাতে পারি৷ ২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা মনে আছে? সে বছরের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর একটি ভবনে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে৷ মৃত্যু হয় ১২১ জনের৷ এই সরকার তখন দীর্ঘ বিরতির পর মাত্রই ক্ষমতায় এসেছে৷ সরকার প্রধান শেখ হাসিনা নিজে সে ঘটনায় আপ্লুত হয়ে পড়েন৷ একটি পরিবারের দুটি মেয়ে ছাড়া বাকি সকলেই আগুনে পুড়ে মারা যান৷ ওই দুই মেয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের কন্যা হিসাবে গ্রহণ করেন৷ তাদেরকে বিয়ে দেন৷ বিষয়টি প্রশংসিত হয় সকল মহলে৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কত এতিম সন্তানকে নিজের পুত্র-কন্যা হিসাবে নিতে পারবেন? কারণ এধরনের ট্যাজেডি তো এই দেশে নিয়মিত বিরতিতে ঘটতেই থাকে৷ ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়, তাতে মারা যায় ৭০ জন৷ বহু লোক আহত হয়৷ ব্যক্তিগতভাবে কতজনের দায়িত্ব নেবেন প্রধানমন্ত্রী?
আসলে ব্যক্তি নয়, প্রশ্নটি সিস্টেমের৷ সরকার যদি দেশে একটা যুক্তিগ্রাহ্য সিস্টেম তৈরি করতে পারে, চালু করতে পারে, তাহলে দায়টা আর এককভাবে একজনের ওপর যেয়ে পড়ে না৷ আবার উল্টো দিকে, কেউ কেউ কিন্তু এমন প্রশ্নও করতে পারেন- সেরকম একটা সিস্টেম চালু রাখার দায়িত্বটা কার?
এই যে মগবাজারের ঘটনা, এর দায় শেষ পর্যন্ত যেয়ে কার ওপর বর্তাবে? বিভিন্ন বিভাগের লোকজন সেখানে গেছেন, মন্তব্য করেছেন, ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন৷ এই যে তদন্ত, সেটা কি প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে দায়ি ব্যক্তিকে সাজার আওতায় আনার জন্য, নাকি নিজেদের প্রতিষ্ঠানটিকে দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য? যেমন ধরা যাক, পুলিশের কথাই৷ আইজিপি নিজে সেখানে চলে গেছেন৷ যেয়ে ঘুরে ফিরে কিছু মন্তব্য করেছেন৷ তারপর একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলেছেন৷ এখন এই তদন্তকমিটি কি আইজিপির মন্তব্যকেই অনুসরণ করবেন না? আসলে এরকম বিষয়ে হুটহাট মন্তব্য করা ঠিক নয়৷
আর একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়৷ একটি ঘটনায় এরই মধ্যে চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ চার বিভাগ মিলিয়ে চারটি তদন্ত কমিটি৷ আচ্ছা, চার বিভাগ মিলিয়ে সমন্বিতভাবে কি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা যেত না? সবকটি বিভাগ তো সরকারেরই অংশ৷ তাহলে সমন্বয় নেই কেন? এসব তদন্ত কমিটি, তাদের সুপারিশ যে আসলে কতটুকু কি কাজে লাগে সেটা এই দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে জানে৷ নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর বলা হয়েছিল, সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল- পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় আর ক্যামিকেল গোডাউন বা কারখানা করতে দেওয়া হবে না৷ বাস্তবায়ন করা গেছে সে সিদ্ধান্ত? কেন যায়নি? কাদের অসহযোগিতার কারণে যায়নি? এই তো মাস দুয়েক আগে, গত ২৩ এপ্রিল পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবার আগুন লাগল কেমিক্যালের গোডাউনে৷ সে ঘটনায় মারা গেল চারজন৷ আহত হলো ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যসহ ১৮ জন৷ এ ঘটনার পর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস যে কথা বললেন, তা খুবই লক্ষ্যণীয়৷ তিনি পুরান ঢাকা থেকে কেমিকেলের গোডাউন না সরায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন৷ তিন জানান, সিটি করপোরেশন কেমিক্যাল গোডাউনের জন্য কোন লাইসেন্স দিচ্ছে না৷ কিন্তু সরকারের অন্য দফতরের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এগুলো এখান থেকে সরানো যাচ্ছে না৷ তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সিটি করপোরেশনের থেকে বাণিজ্য অনুমতি ছাড়াই তারা কীভাবে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করে, কীভাবে গুদামজাত করে এবং কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে?
খোদ সিটি করপোরেশনের মেয়রের এমন প্রশ্নের জবাব কে দেবে? কেউ কি দিয়েছে? তিনি সরকারেরই অন্য কিছু বিভাগের ওপর দায় চাপিয়েছেন৷ তারাও কি এতে কোন প্রকার দায় অনুভব করেছেন? এসব প্রশ্ন-পালটা প্রশ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত যে বিষয়টি বের হয়ে আসে, সেটা হচ্ছে সরকারের সমন্বয়হীনতা৷ সেটা কি সরকার বা সরকার প্রধানের জন্য স্বস্তিদায়ক কিছু হবে?
মগবাজারের ঘটনায় আবার আসি৷ এরই মধ্যে যতগুলো সম্ভাবনার কথা জানা গেছে- সেগুলোর দিকে বরং একবার তাকানো যাক৷ ভবনটিতে কোনো গ্যাস সংযোগ ছিল না৷ ধারণা করা হচ্ছে- নিচতলার শরমা হাউস থেকেই বিস্ফোরণ ঘটেছে৷ কিন্তু সেখানকার গ্যাস সিলিন্ডারটি অক্ষত রয়েছে৷ তাহলে কি এটা নাশকতামূলক কোনো কাজ? নাশকতার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এমন কোনো বোমা বা বিস্ফোরকের অস্তিত্বও সেখানে পাওয়া যায়নি৷ তাহলে এত বড় একটা বিস্ফোরণ হলো কি করে? কেউ কেউ বলছেন- এই ভবন বা আশপাশের স্যুয়ারেজ লাইন থেকে সৃষ্ট গ্যাস হয়তো ভবনের কোন জায়গায় জমা হয়ে ছিল৷ কোনোভাবে আগুনের একটি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার পরই এই বিস্ফোরণ ঘটেছে৷ এমন সন্দেহের অবশ্য কারণ আছে৷ কারণ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের অনেকেই বলেছেন, তারা সেখানে মিথেন গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন৷ আর স্যুয়ারেজের আবর্জনা থেকে সাধারণত মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়৷
এই শেষ তথ্যটি আর একটি ভয়ংকর আশঙ্কা তৈরি করে৷ এই নগরীতে বছর কয়েক আগে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে বক্স কালভার্ট তৈরি করা হয়েছিল৷ স্যুয়ারেজ সিস্টেমের সেই অংশগুলো কি তাহলে এতদিনে এক একটা মিথেন গ্যাসের বোমায় পরিণত হয়ে আছে? বক্সকালভার্টের আশপাশে অনেক কটি বহুতল ভবনও এরই মধ্যে গড়ে ওঠেছে৷ সেই সব ভবন, তাদের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বক্স কালভার্টগুলো নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার সময়ও বোধকরি এতদিনে হয়ে গেছে৷
কিন্তু চিন্তাভাবনা কে করবে? আবার সেই প্রথম প্রশ্নটিই এসে যায়৷ দুর্ঘটনার দায় নেওয়ারই লোক যেখানে নেই, নতুন করে চিন্তাভাবনার লোক কোথা থেকে আসবে? দায় কেউ নিতে চায় না বলে কি দায় কারও উপর বর্তাবে না? যুক্তি অনুযায়ী দায়িত্ব যিনি নিয়েছেন, দায় তো তারই উপর যাওয়ার কথা৷ উন্নত দেশে এই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কিন্তু জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন৷ দায়বদ্ধ থাকেন এ কারণে যে, নির্দিষ্ট সময় পর পর জনগণের কাছেই তাদেরকে যেতে হয়৷ আর দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা জনগণের সেবক হয়েই থাকেন, মালিক হওয়ার ঔদ্ধত্য দেখাননা৷
আবার সেই সাবিবের কথা দিয়েই শেষ করি৷
একদিন ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছি৷ বাংলামোটর মোড়ে বড় রাস্তা পার হবো, পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে৷ ভিআইপি যাবে৷ ছেলে আমার ভিআইপি দেখবে৷ ভাবলাম- ফুটওভারব্রিজে উঠে দেখাই৷ কিন্তু পুলিশ আটকাল৷ ব্রিজের ওপর ওঠা যাবে না৷ এদিকের ছেলের স্কুলের সময় চলে যাচ্ছে৷ কি আর করা, আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম৷ শো শো করে বাঁশি বাজিয়ে ভিআইপির গাড়িবহর চলে গেল৷ তারপর আমরা রাস্তা পাড় হতে পারলাম৷ শুরু হলো ছেলের প্রশ্ন- বাবা ভিআইপি কোথায়?
‘‘ওই যে গাড়িতে যে গেল, উনিই তো ভিআইপি৷''
‘‘ভিআইপি তাহলে মানুষ!''
‘‘হুম, মানুষ৷ সরকারের বড় বড় মানুষ৷ মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী৷''
‘‘কিন্তু সরকার তো আমাদের টাকায় চলে৷ সে তাহলে ভিআইপি কেন? তার যাওয়ার সময় আমাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কেন?''
এ প্রশ্নের জবাব সেদিন নিশ্চয়ই আমি সেদিন দিয়েছিলাম৷ কী ছিল সেই জবাব, সেটা এখানে বলব না৷ আমরা তো এমন অনেক কথা কাছের মানুষকে বলি, যা প্রকাশ্যে জনসমক্ষে বলা যায় না৷