একুশের অর্জন এখনও অসম্পূর্ণ
২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৯অসংখ্য শহীদের রক্তে স্নাত হয় বাংলার মাটি৷ বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা পরিণত হয় ক্ষোভের ভাষায়৷ অবশেষে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়৷
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই অংশের মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে বিরাট বৈষম্য৷ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব দিক দিয়েই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল হতে থাকে অবহেলিত৷ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে লুপ্ত করার যড়যন্ত্র চলতে থাকে তখন থেকেই৷ সমগ্র পাকিস্তানে মাত্র তিন শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু৷ ৫৬ শতাংশের ভাষা বাংলা৷ এমনকি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের অধিবাসীদের মাতৃভাষাও উর্দু নয়৷ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও উঁচু শ্রেণীর ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের ভাষা উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন৷ বাঙালি নেতা ও রাজনীতিবিদদের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও চলতে থাকে এব্যাপারে প্রস্তুতি পর্ব৷ ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্রসমাজ৷ দাঁনা বাধতে থাকে ভাষাআন্দোলন৷ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নানা শ্রেণী পেশার মানুষ সমর্থন ও সহমর্মিতা জানায় এই আন্দোলনে৷ চলতে থাকে ধর্মঘট, সভা, সমাবেশ৷ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি৷ ছাত্রজনতার এক মিছিলে গুলি বর্ষণ করতে দ্বিধা করেনা পুলিশ৷ লুটিয়ে পড়ে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও আরো অনেকের দেহ৷
মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এভাবে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বেই বিরল৷ অবশেষে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ১৯৫৪ সালের ৭ মে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়৷ আর একুশের ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম পূর্ণতা পায় একাত্তরের স্বাধিকারের লড়াইএ৷ আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ৷
৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির পর অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেছে৷ কিন্তু বাঙালি একুশের চেতনা লালন করছে আজো৷ তাই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাংলাদেশের মানুষ হয়ে ওঠে স্মৃতিবিজরিত, আবেগাপ্লুত৷ একুশ অনেক আগেই শোক দিবসের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাঙালির অহংকারের দিবসে পরিণত হয়েছে৷ নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও বড়দের কাছে শুনে শুনে একুশের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে৷ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয় প্রভাতফেরিতে৷ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শহীদ মিনারে৷
কিন্তু দুঃখের বিষয় একুশের অর্জন এখনও অসম্পূর্ণ৷ বাংলাদেশের সর্বস্তরে এখনও বাংলা চালু হয়নি৷ ভাষার উন্নতি ও বিকাশসাধনে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি অনেকে৷ ইংরেজি, উর্দু, হিন্দির অহেতুক ও অবান্তর ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় সমাজের কোন কোনো শ্রেণীর মানুষের মধ্যে৷
মাতৃভাষাকে অবহেলা না করেও যে অন্য ভাষা শেখা যায়, সেই চেতনাটাই জাগিয়ে তুলতে হবে মানুষের মধ্যে৷ বাংলা ভাষাকে যুগের উপযোগী ভাষায় পরিণত করতে হবে৷
মাতৃভাষার জন্য অনুভূতি বা একুশের চেতনা আজ শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই৷ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও স্বীকৃতি পেয়েছে এই ভাষা দিবস৷ ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রক্ষিতে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালন করা হচ্ছে৷ বিশ্বের অনেক শিল্পোন্নত দেশের অধিবাসীরাও তাদের মাতৃভাষা নিয়ে চিন্তিত৷ জার্মান ভাষা সমিতির এক সমীক্ষায় জানা গেছে, জার্মানির অধিকাংশ মানুষই মনে করেন জার্মান ভাষা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে প্রবীনরাই এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন৷ এর কারণ হিসাবে তারা মনে করেন, আজকাল ছেলে মেয়েরা বই পড়ার চেয়ে টিভি দেখা বা কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে বেশি৷ এ ছাড়া বিদেশি বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার প্রভাব জার্মান ভাষাকে পেছনে হটিয়ে দিচ্ছে৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ভাষার সুরক্ষার ব্যাপারে উদাসীন৷ তাই একুশ এলে জার্মানিতেও ভাষা নিয়ে চিন্তা ভাবনার সুর কিছুটা স্পষ্ট হয় ওঠে৷
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত জার্মানিতে বসবাসকারী বাঙালিরাও একুশে ফেব্রুয়ারি এলে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন৷ বিশেষ করে বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও বন শহরের বাঙালি সংগঠনগুলি প্রতি বছর স্মরণ করেন শহীদ দিবসকে৷ বনের বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টার ১৯৮৯ সাল থেকে পালন করে আসছে ২১ ফেব্রুয়ারি৷ এ বছরও একুশকে নিয়ে রয়েছে তাদের বিশেষ আয়োজন৷ স্থানীয় ক্ষুদে শিল্পীরা পরিবেশন করবে গান, আবৃত্তি করবে কবিতা৷ পাশাপাশি থাকছে বড়দের সংগীত এবং আলোচনা অনুষ্ঠানও৷
ফ্রাঙ্কফুর্টে বাঙালি সংগঠন বাংলা থিয়েটারের উদ্যোগে স্থানীয় শিল্পীরা আয়োজন করেছেন এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের৷ সংগীতের পাশাপাশি একটি নাটকও থাকছে৷ এস এম সুলায়মানের ‘‘খ্যাপা পাগলার প্যাচাল''৷