একাধিক মৃত্যুকূপের তীর থেকে বেঁচে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা শিখা
১১ অক্টোবর ২০১১‘‘যুদ্ধ শুরু হলে আমার বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন সপরিবারে ভারত চলে যাওয়ার৷ আমরা ছয় ভাই-বোন এবং বাবা-মা রওয়ানা দিলাম৷ অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কুমিল্লা পৌঁছলাম৷ সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি৷ রশিদ মিয়ার বাড়ি৷ সেখানে মিষ্টি আলু সিদ্ধ, ভাতের মাড় এবং খুদের জাও খেতে দেয় আমাদের৷ এরপর গোয়াল ঘরে ইট মাথায় দিয়ে ঘুমাতে হয়৷ এর মধ্যে রাত ২/৩ টার দিকে বিশাল মশাল জ্বালিয়ে রশিদ মিয়ার বাড়িতে একদল ডাকাত এসে হাজির৷ আমার বাবা খুব ভয় পেয়ে যান৷ কিন্তু রশিদ মিয়া অভয় দিয়ে বলেন আপনারা স্রষ্টাকে ডাকতে থাকুন৷ ভয় পাওয়ার কিছু নেই৷ আমি সব ব্যবস্থা করবো৷ ডাকাত দল দরজায় আঘাত করলে রশিদ মিয়া গিয়ে দরজা খোলেন৷ তারা রশিদকে জিজ্ঞেস করে, তিনি বাড়িতে কোনো হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন কিনা৷ তিনি তা অস্বীকার করেন৷ বলেন, না আমি কোনো হিন্দু পরিবারকে জায়গা দিইনি৷ ডাকাতরা কোরআন শরিফ ছুঁয়ে দিব্যি খাওয়ার কথা বলে৷ রশিদ মিয়া ঘর থেকে কোরআন শরিফ এনে তা মাথায় ও বুকে ছুঁয়ে কসম করে বলেন, তিনি কোনো হিন্দুকে বাড়িতে আশ্রয় দেননি৷ ফলে ডাকাতরা তাঁর কথা বিশ্বাস করে চলে যায়৷ আমার মা রশিদ মিয়াকে বলেন, আপনি এ কী করলেন, দাদা? কোরআন শরিফ নিয়ে কসম করলেন, আপনার কোনো ক্ষতি হবে না তো? তিনি উত্তর দেন, না দিদি, আপনারা আট জনের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমি এটা করেছি৷ এতে কোনো ক্ষতি হবে না৷''
নারায়ণগঞ্জ থেকে ভারত পাড়ি দেওয়ার সময় এভাবেই বেশ কয়েকবার মৃত্যুকূপের তীর থেকে বেঁচে গেছেন শিখা এবং তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোন৷ তিনি জানান, ছয় ভাই-বোন এবং বাবা-মা যখন শীতলক্ষা নদী পার হওয়ার জন্য নৌকায় ওঠেন, তখন বেশ কাছেই পাকিস্তানি সেনাদের দেখতে পান তাঁরা৷ কিশোরী মেয়ে হিসেবে শিখাকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে যাবে এই ভয়ে তাঁর বাবা শিখাকে নৌকার পাটাতনের নীচে লুকিয়ে রেখেছিলেন৷ এছাড়া তাঁর এক বছর বয়সি ছোট্ট বোন কাঁদছিল বলে নৌকার অপর যাত্রীরা তাঁর মাকে বলেছিলেন ছোট্ট শিশুটিকে গলা টিপে নদীর পানিতে ফেলে দিতে৷ তবে এতোটা নির্দয়-নিষ্ঠুর হওয়া সম্ভব ছিল না তাঁর মায়ের পক্ষে৷ ছোট্ট বোনটির মুখে ফিডার দিয়ে কোনো রকমে চুপ করানো হয়েছিল৷ এরপর আবারও সীমান্ত পার হওয়ার জন্য দালাল ধরতে গিয়ে এক ডাকাতের হাতে পড়ে যান তাঁরা৷ তবে সেই দফাও স্বয়ং সেই ডাকাতের বৌ-ছেলের সহযোগিতার কারণে প্রাণে বেঁচে যান৷ অপর দালাল ধরে তখনকার দিনে ৩০০ টাকা দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত পৌঁছেন শিখা এবং তাঁদের পরিবার৷
১৯৫৬ সালের পহেলা জুলাই নারায়ণগঞ্জের মিশনপাড়ায় জন্ম সাহসী নারী শিখা চক্রবর্তীর৷ পিতা কৃষ্ণ কমল চক্রবর্তী এবং মা অনিতা চক্রবর্তী৷ বৈবাহিক সূত্রে শিখা ভট্টাচার্য হিসেবে পরিচিত৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সময় মাত্র ১৫ বছরের কিশোরী শিখা৷ এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি৷ কিন্তু যুদ্ধ শুরুর কারণে সেবছর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি৷ পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে গিয়ে হাজির হন ভারতের ত্রিপুরায় সূর্যমনি শিবিরে৷ পরে বিজয়নগর শিবিরে যান তাঁরা৷ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাই এডওয়ার্ড কেনেডি ঐ শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বলে জানান শিখা৷
এরপর বাবা-মার অনুমতি নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নেন শিখা৷ তবে শুটিং-এ দক্ষতা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি তাঁর৷ বরং তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিয়ে আগরতলায় অবস্থিত জিবি হাসপাতালে দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত তিনি সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় রত ছিলেন৷ অনেক সময় যুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্ত মুক্তিসেনাদের বিভৎস অবস্থা দেখে রাতে ঘুমাতে পারতেন না, খেতেও পারতেন না শিখা এবং তাঁর সহকর্মীরা৷ সেখানে তৎকালীন ‘কে' ফোর্সের প্রধান যুদ্ধাহত জেনারেল খালেদ মোশাররফের পরিচর্যা করেন তিনি৷
দেশ স্বাধীন হলে ২৮শে ডিসেম্বর বাংলাদেশে ফিরে আসেন শিখা এবং তাঁদের পরিবার৷ কিন্তু এসে দেখেন বাড়িঘর সব লুটপাট হয়ে গেছে, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তবুও জন্মভূমিতে স্বাধীনভাবে নতুন জীবন শুরু করেন তাঁরা৷ পরে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে যোগ দেন তিনি৷ এখনও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বুকে নিয়ে আগরতলার জিবি হাসপাতালের মতোই চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন এই সাহসী ও ত্যাগী নারী মুক্তিযোদ্ধা৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ