এক চুমুকেই ঠান্ডা
গরমের দাবদাহ শুরু হতে না হতেই কলকাতার রাস্তাঘাটে হরেক পানীয়ের সম্ভার৷ চিনা পরিব্রাজক ই-সিঙ সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলায় পেয়েছিলেন নানা পানীয়ের সুলুক সন্ধান৷ এ যুগেও সেই ধারা অব্যাহত৷
গেলাসই গন্তব্য
অতীতে বাবুর বাড়ির অতিথি আপ্যায়নে শ্বেতপাথরের গেলাসে কেওড়ার গন্ধ মেশানো জলপানের চল ছিল৷ হাল আমলে অতিথিদের জন্য বরাদ্দ কাঁচের গেলাসে স্কোয়াশ বা রঙিন সরবত৷ তৃষ্ণার্ত পথচারীরা অবশ্য দইয়ের ঘোল, ঠান্ডা জল বা বেলের পানা পেলেই খুশি হন৷ উত্তর কলকাতার একটি সরবতের দোকানে৷
লাল-নীল-সবুজের মেলা
রঙিন পানীয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি৷ তাই বঙ্গজীবনে রঙ-বেরঙের ফ্লেভারের উৎপত্তি৷ এক বিন্দু রঙিন সিরাপ ঢেলে দিলেই মন ভালো হয়ে যায় জ্বালাপোড়া গরমেও৷ রাস্তাঘাটে তীব্র গরমে এমন বন্ধু আর কে আছে?
খেয়ে আরাম খাইয়ে আরাম
যতই কৃত্রিম, রঙিন পানীয় বাজার দখল করুক না কেন, আজও বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে বিশুদ্ধ পাতিলেবুর জল৷ আদি ও অকৃত্রিম, বর্ণহীন লেবু জলের বিকল্প বাঙালি আজও পায়নি৷ দমদম স্টেশন চত্বরে লেবুজলের পসরা৷
এসো শ্যামল সুন্দর
আগে গ্রামবাংলায় উনুনের মরা আগুনে কাঁচা আম পুড়িয়ে তার ফ্যাকাসে তুলতুলে শাঁস চটকে চিনি, বাতাসা বা মিছরি দিয়ে সরবত তৈরি হত৷ বোতলবন্দি ‘কর্পোরেট’ আমপান্নার যুগেও অবশ্য কলকাতার রাস্তার ধারে আম-পুদিনার বিক্রিতে ভাটা পড়েনি৷
ছাতু-জল থইথই
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘একসময় ভাল ছাতু-মাখিয়ে বলে আমার নাম ছিল৷’’ কাজেই ছাতুর সরবত কেবল বিহারি-মারোয়াড়িদেরই একচেটিয়া নয়৷ ঠেলাগাড়ি চেপে পথচারীর নাগালেই থাকে ছাতুর সরবত৷ বেলাশেষে কত উপার্জন হলো, মানিকতলায় সেটাই গুনছেন বিক্রেতা৷
হাত বাড়ালেই ঠান্ডা
সেকালে বাঙালির বিশেষ পানীয়কে পানা বলা হতো৷ যেমন চিনির পানা, বেলের পানা ইত্যাদি৷ এ কালেও সেই পানীয়ের দেখা মেলে৷ বিপুল চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে কৃত্রিম পানীয়ের সম্ভার৷ সুইচ টিপলেই শীতল স্রোত৷
তাপহরা তৃষাহরা
কয়েক দশক আগেও পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে ফ্রিজের এত চল ছিল না৷ রাস্তায় রাস্তায় বরফের গোলা বা সামান্য বরফকুচি মেশানো কাঁচা আমপোড়া, পুদিনাপাতার সরবত ছিল বাঙালির গ্রীষ্মের স্বর্গ৷ কলকাতার ভিড়ে ভরা ফুটপাতে এ কালেও এক চুমুকে স্বর্গলাভ হয় বৈকি! যেমন এই কলেজ স্ট্রিটে৷
সরবত যেন কুটিরশিল্প
পশ্চিমবঙ্গে তেলেভাজার পাশাপাশি অন্যতম জনপ্রিয় লগ্নি সরবতেই৷ অল্প খরচে, কম মজুরিতে, ন্যূনতম স্থানে অনায়াসে খুলে ফেলা যায় সরবত তৈরির ব্যবসা৷ উপমহাদেশের গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ায় চোখ বুঁজে কমপক্ষে তিন মাস দেদার আয়৷
কু ঝিক ঝিক পানীয়
গরম পড়তেই রেলের প্ল্যাটফর্মের দৃশ্যও বদলে গেছে৷ কেক-বিস্কুট-প্যাটিসের দোকানে রাতারাতি হাজির সারি সারি পানীয়ের বোতল৷ কুঁজো, জালা বা ঘটির যুগ আর নেই৷ প্যাকেজিংয়ে মোড়া যুগে বোতলই আমাদের সভ্যতার ধারক ও বাহক৷ পথচারী, ট্রেনযাত্রী বা অফিসকর্মী সকলেই বোতলের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন৷
বাণিজ্যে বসতে সরবত
‘প্যারামাউন্ট’ কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় প্রাচীন সরবতের দোকান৷ ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বহু নায়ক-গায়ক-খেলোয়াড়ের স্মৃতিধন্য এই খানদানি সরবতী বিপণী কলেজ স্কোয়্যারের অলঙ্কার৷
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
কাজের ফাঁকে দু’চুমুকে যদি গরম থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, তবে তাই সই! কলকাতার অন্যতম প্রাচীন ঘোলের দোকান ‘কপিলা আশ্রম’-এ সরবত প্রেমীদের ভিড়৷ বিধান সরণীতে৷
সকল রসের ধারা
চিনা পরিব্রাজক ই-সিঙের ডায়েরি থেকে জানা যায়, সেকালে বাঙালিদের মধ্যে তালের রস, খেজুরের রস জনপ্রিয় ছিল৷ আমবাঙালির হাতে এখন সেগুলি সবসময় না পৌঁছালেও অনায়াসে জুটে যায় রসরাজ ইক্ষুশর্করা৷ হেদুয়ার ফুটপাতে সে-ই রাজা৷
এলাম-দেখলাম-জয় করলাম
ঠান্ডা পানীয়ের বিজ্ঞাপনী ভাষা রপ্ত করেছে নব্য বঙ্গ৷ তর্ক-বিতর্ক-আড্ডা-স্লোগানে নিজেদের প্রমাণ করতে তারা বেছে নিয়েছে বোতলবন্দি ঠান্ডা পানীয়ের ‘জোশ’৷
সরবতী সঙ্গ সুধা
দহনজ্বালা জুড়াতে চাইলে করুণাধারায় এসো৷ তাই কি প্রখর গ্রীষ্মে সম্পর্কের ভাঙ্গাগড়ার খেলায় বান্ধবীর সঙ্গে দু’দণ্ড শান্তির খোঁজ?
শীতল জমায়েতে উষ্ণতা
কলেজ ক্যান্টিন হোক বা ‘প্যারামাউন্ট’– বন্ধুবান্ধবদের হইচই আর ঠান্ডা আমোদ জমে ওঠে গেলাসে রাখা সরবত ঘিরেই৷
আমার সন্তান যেন থাকে পানীয়তে
কোনও কোনও সম্পর্ক অনিবার্য৷ মা ও সন্তানের মধ্যে জীবন যেন মরুদ্যানের মতো৷ সব প্রতিকূলতা, রুক্ষতার বিপরীতে শাশ্বত বিজ্ঞাপন৷ তৃষ্ণা মেটায়, আশ্রয় জোগায়৷
মেঘ দে, পানি দে
জাতীয় পানীয় বলতে যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটা জল বা পানি৷ পানি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত পানীয় থেকে৷ গরমে রঙিন বা কৃত্রিম পানীয়ের থেকে স্রেফ সাদা পানির আবেদন সততই তীব্র৷ তাই করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, ‘পানি দে’৷ নগরজীবনের ভিড়,কোলাহল,ব্যস্ততা থেকে ছুটি চায় মন৷ গতির সঙ্গে পাল্লা না দিয়ে মানুষ চায় ক্ষণিকের বিশ্রাম৷ সদা ব্যস্ত নাগরিকের সেই তৃষ্ণা মেটে কি?