‘এইটা নাকি আমাদের দেশ!'
১৪ অক্টোবর ২০২১কাল থেকে খুব বিষণ্ণ লাগছে৷ কুমিল্লায় বড় হয়েছি৷ তাই এখানকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক ঔদার্য্য সম্পর্কে গলা বড় করে বলতে পারি৷ বলতে পারি, সেখানে যে ধর্মেরই হোক না কেন, মানুষে মানুষে সহাবস্থান কতটা! কিন্তু, এ কী দেখলাম কাল? শহরের মধ্যিখানে দুর্গাপূজায় মণ্ডপে হামলা? পূজার মূর্তির পায়ের কাছে মুসলিমদের ধর্মীয় গ্রন্থ রাখা?
এখন পর্যন্ত নানাজনের সঙ্গে কথা বলে, ফেসবুকে অসংখ্য ভিডিও দেখে, পত্রিকার খবর পড়ে যা বুঝলাম, ঘটনাটি কী ঘটেছে, তা নিয়ে কয়েকটি তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে৷
প্রথমত, কেউ কেউ বলছেন, ‘৯০ শতাংশ (কেউ দেখলাম বলছেন ৯৬%) মুসলমানের দেশ' বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মকে অবমাননার উদ্দেশ্যে ৪ থেকে ৯ শতাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এমন কাজ করেছেন৷ তো প্রথমেই বলে রাখি, শুধু ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ নয় বাংলাদেশ, এটি ১০০ ভাগ বাংলাদেশির দেশ, যেখানে অনেক ধর্মের মানুষ থাকেন৷ আর বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছরই মার খান৷ এখন এটা যেন নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাদের মন্দিরে হামলা করে, প্রতিমা ভাঙচুর করে সংখ্যাগুরুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাবার যেন একটা হিড়িক পড়ে গেছে৷ একটা ভয় বা নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে তারা বাস করেন৷ এ অবস্থায় কেউ মুসলিমদের ক্ষেপিয়ে, তাদের ধর্মীয় গ্রন্থকে অবমাননা করে যেচে মার খেতে চাইবেন, এই যুক্তি কতটা টেকে?
আরেকটি তত্ত্ব হল, এটা একটা ‘সাবোটাজ'৷ কিন্তু হয়েছে আয়োজক বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দু'টি পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে৷ স্থানীয়ভাবে এই যুক্তিটা দিচ্ছেন কেউ কেউ৷ তো এই তত্ত্বেও ওপরের যুক্তি খাটে৷ আর সূর্য পূর্ব দিকে উঠলে শুধু পূর্বপাড়ার মানুষেরই না, গরম লাগে পশ্চিমপাড়ার মানুষেরও৷ যুগে যুগে পশ্চিমপাড়ার মানুষেরা এটা দেখেছেন, জানেন৷ তাই পূর্বপাড়ার ক্ষতি করার জন্য সূর্যকে ঘুস নিশ্চয়ই দেবেন না তারা৷
তৃতীয় আরেকটি তত্ত্ব হল, রাজনৈতিক কারণে এটি করা হয়েছে৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একে অপরকে বিপদে ফেলতেই এটি করেছে৷ এর স্থানীয় তত্ত্ব যেমন আছে, আছে জাতীয় তত্ত্বও৷ বলা হচ্ছে, স্থানীয় সাংসদকে বিপদে ফেলতে তার অবর্তমানে এমনটি করা হয়েছে৷ আবার বলছে, শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলতে এমনটি করা হয়েছে৷ তো ভোটের রাজনীতি যদি হিসেবই করা হয়, তাহলে ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের অনুসারীদের ওপর যে কোন হামলায় তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগেরই বেশি লাভবান হবার কথা৷ কারণ এই দলটি আপাত দৃষ্টিতে অসাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির কথা বলে৷ তো দলটি সরকারে থাকলে সব ধর্মের মানুষেরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷ একের পর এক ঘটনায় তা তারা করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না৷
চতুর্থ তত্ত্ব, উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী এসবে ইন্ধন দিচ্ছে৷ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছে৷ সাধারণ মুসলিমরা তাদের এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন৷ আগের অনেকগুলো ঘটনাও এমন৷ উত্তেজিত মানুষ যে কোন কিছু করতে পারেন৷ ‘মব সাইকোলজি' খুব অদ্ভুত৷ যদি এই তত্ত্ব সত্য হয়, তাহলে এসব ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে৷ জনসমক্ষে আনতে হবে৷
পঞ্চম তত্ত্ব, ভারতের দালালরা এখানে এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে৷ তারা এখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফায়দা লুটতে চায়৷ ভারতের জুজুর ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার কায়দাটা বাংলাদেশে প্রায় সবারই জানা৷ তবে অনেক সময় আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক পর্যায়ের ‘পপুলিস্ট ট্রেন্ড'-এর প্রভাব পড়ে স্থানীয় পর্যায়ে৷ তাই এসব বিষয়গুলোও দেখা দরকার৷
ওপরের তত্ত্বগুলোর কোনটা কতটা সত্য তা প্রশাসন তদন্ত করে বের করবে৷ আসল কথা হল, যারা ঘটনার পর লাইভ করে ‘তৌহিদি‘ জনতাকে জাগাতে চেয়েছেন, একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছেন, দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছেন, তারা মোটামুটি সফল৷ কারণ, কুমিল্লায় নানুয়া দিঘীর পাড়ের একটি মণ্ডপের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মন্দিরে হামলার ঘটনা মোটেই সরলরৈখিক নয়৷
কিন্তু আমার কানে বাজছে, সেই নারীর কান্না, যিনি নানুয়া দিঘীর ধংসস্তুপের পাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘এইটা নাকি আমাদের দেশ!' আরেকটি দেশে সংখ্যালঘু হয়ে বেঁচে থাকা আমার কাছে তাই তার এই কান্না খুব কষ্টের৷ কবে আমরা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারব?