‘হিন্দুদের বাংলাদেশ ত্যাগ বাড়তে পারে’
২ নভেম্বর ২০১৬ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে গিয়ে হামলার শিকার হিন্দু পরিবারগুলোর অবস্থা দেখেছেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল৷ ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগ করেন, পরিকল্পিতভাবে অনেকটা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণেই হামলা চালানো হয়েছে৷
সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘জেলা ও পুলিশ প্রশাসন হেফাজত এবং আহলে হাদিসকে প্রতিবাদ সভার অনুমতি কিভাবে দিল সেটাই বড় প্রশ্ন৷ এমনকি হামলার সময় কিছু পুলিশ সদস্য সেখানে থাকলেও অজ্ঞাত টেলিফোন পেয়ে তারা চলে যায়৷ আমরা হামলার শিকার কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তারা প্রাণ ভয়ে বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন৷ এখন ফিরে এসেছেন৷''
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সভাপতি কাজল দেবনাথও বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখনো আতঙ্ক কাটেনি৷ পরিকল্পিত এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ বছরের পর বছর ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামরা ও নির্যাতন হচ্ছে, এটা তারই ধারাবাহিকতা৷''
ধারাবাহিক হামলা
চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলেন করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছিল, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসে প্রায় তিনগুণ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ – এই তিন মাসে ৮২৫০টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্যে হত্যা, অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা, গণধর্ষণ, জমিজমা ঘরবাড়ি মন্দির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছেদের ঘটনাও রয়েছে৷ তাঁরা জানান, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ২৬১টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ তাতে ১৫৬২টি প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ কিন্তু ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে ৭৩২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের ঘটনার প্রায় তিনগুণ৷ এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৬৬টি, যা আগের এক বছরের তুলনায় ছয়গুণেরও বেশি৷ এ সময়ে ১০ জন নিহত, ৩৬৬ জন আহত এবং ১০ জন হিন্দু অপহৃত হন। জোরপূর্বক ধর্মান্তরের অভিযোগ রয়েছে ২টি৷ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮ জন৷ জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৬৫৫টি৷ এছাড়া ঐ সময়ে কমপক্ষে ২২টি হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি দেয়া হয়৷
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বরিশাল, বাগেরহাট, পাবনা ও নড়াইলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ এরপর থেকে একযোগে বিভিন্ন সংখ্যালঘু নির্যাতন কমে এলেও তা থামেনি৷ এরপর ২০১২ সালের অক্টোবরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরণের হামলা হয়৷ আর সর্বশেষ গত রবিবার ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসির নগরে হিন্দুদের শতাধিক বাড়ি-ঘরে হামলা-ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়৷ সেদিন অন্তত ১০টি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়৷ হিন্দু পল্লিতে নারী-পুরুষকে বেধড়ক পেটানো হয়৷
ডয়চে ভেলেকে কাজল দেবনাথ বলেন, ‘‘এই ধারাহিক হামলায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে৷ রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে যেভাবে ফেসবুক পোস্টের অজুহাত তুলে হামলা চালানো হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও একইভাবে হামলা হয়৷ ওই এলাকা থেকে দু'জন মন্ত্রী আছেন সরকারে৷ তারা চুপ৷ তাদের একজন ঘটনা আড়াল করার জন্য নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছেন৷ সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চাইলে তাদের ‘মালাউনের বাচ্চা' বলে গালি দেয়া হচ্ছে৷''
হিন্দু জনসংখ্যা কমার কারণ কী?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০০১ ও ২০১১ সালের তথ্য তুলনা করলে দেখা যায় ১৫টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে৷ ১০ বছরে মোট ৯ লাখ হিন্দু কমেছে৷
বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ ও পাবনা জেলায় এই সময়ে যে হিন্দুদের সংখ্যা কমেছে তা জরিপে স্পষ্ট৷
বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২ ভাগ ছিল হিন্দু৷ ২০১১ সালে তা হয় ৮ দশমিক ৫ শাতাংশ৷ আর স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫ ভাগ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ তবে ২০১৫ সালের হিসেবে হিন্দু জনসংখ্যা বাড়ছে বলে জানায় বিবিএস৷ তাতে বলা হয়, মোট জনসংখ্যার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ হিন্দু৷ আর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে তা ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ৷
অ্যাডভাকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘জরিপ দেখে বলতে হবে কেন, আমার পরিচিত অনেক হিন্দু পরিবারই দেশ ত্যাগ করেছে৷ অনেক শহর ফাঁকা হয়ে গেছে৷ তারা প্রধানত নিরাপত্তার কারণেই বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ আর এবারের ঘটনার পর আরো যদি কোনো পরিবার দেশ ছেড়ে চলে যায় তাহলে তাদেরতো দোষ দেয়া যাবে না৷''
একই প্রসঙ্গে কাজল দেবনাথ বলেন, ‘‘পরিস্থিতি যা, তাতে হিন্দুদের দেশত্যাগ বাড়তে পারে৷ কিন্তু আমরা কেন দেশ ছাড়বো? আমরা আমাদের জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় যাবো? আমরা শুধু প্রতিবাদ নয়, এবার প্রতিরোধ করতে চাই৷''
নাসিরনগরে হামলার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সার্বজনীন মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নির্মল দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রবিবার ১২শ'র মতো তরুণ লাঠি ও দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়৷ মন্দিরের পুরোহিতের ওপরও হামলা চালানো হয়৷ তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন৷ হামলাকারীরা বাড়ি ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়, প্রতিমা ভাঙে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে৷ সবাই যার যার বাড়িতে অবস্থান করছেন৷''
এদিকে এই ঘটনায় দায়িত্বহীন পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে নাসিরনগর থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কিছু বলার আছে? জানাতে পারেন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷