এ কেমন গণতন্ত্রের উৎসব!
২১ ডিসেম্বর ২০২১প্রত্যাশা মতোই ফল হয়েছে। কলকাতা পুরভোটে বিরোধীদের কার্যত হোয়াইট ওয়াশ করে দিয়েছে শাসকদল তৃণমূল। ছোট লালবাড়ি তাদের দখলেই থাকবে।
প্রত্যাশা মতোই গণমাধ্যমের সামনে বাইট দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, ''গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। ভো-কাট্টা বিজেপি। উৎসবের মেজাজে ভোট দিয়েছেন কলকাতার মানুষ।''
রাজনীতিবিদেরা এমনই বলে থাকেন। কিন্তু সত্যিই কি উৎসবের মেজাজে ভোট দিতে পেরেছেন কলকাতার মানুষ? দিল্লির গত বিধানসভা নির্বাচনে উৎসবের মেজাজ দেখেছিলাম। শাসক-বিরোধীর ক্যাম্প পাশাপাশি। এক ক্যাম্প অন্য ক্যাম্পের জন্য বিরিয়ানি অর্ডার করছে। সেজেগুজে হাতে কালি লাগাতে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, কিন্তু রাজনৈতিক গুণ্ডামি অথবা সংঘর্ষ নেই।
সম্প্রতি ত্রিপুরা গিয়ে এই আলোচনাই হচ্ছিল তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতাদের সঙ্গে। ত্রিপুরায় তখন পুরভোট চলছে। থানায় ঢুকে তৃণমূলের নেতাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল বিজেপি। চোখের সামনে সেই ঘটনা দেখেছি। কীভাবে বিরোধীদের প্রার্থী দিতে দেয়নি শাসক দল বিজেপি, সে কাহিনি শুনেছি বাম এবং তৃণমূলের নেতাদের কাছ থেকে। ভোটের দিন বুথ দখল, ছাপ্পা, রিগিং, বুথ জ্যামের গাদা গাদা অভিযোগ এসেছে বিরোধীদের তরফ থেকে। আর ফলাফলের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব বলেছেন, গণতন্ত্রের জয় হলো।
ছবিটা কেমন চেনা চেনা লাগছে না? কলকাতা পুরভোটে বিজেপির অভিযোগগুলি কেমন ত্রিপুরায় তৃণমূলের অভিযোগের মতো শোনাচ্ছে না? কলকাতা পুরভোটের দিন বাম, কংগ্রেস, বিজেপি একসঙ্গে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। পরিকল্পনা করে নয়, দায়ে পড়ে। ত্রিপুরায় দেখেছিলাম, প্রায় একই সময়ে থানার বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে বাম আর তৃণমূল।
আসলে দুই জায়গার ছবিটা একই। শাসকের বিরুদ্ধে বিরোধীদের ক্ষোভ। আর যুযুধান দুইপক্ষের সংঘর্ষে উলুখাগড়ার মতো অবস্থা হয় সাধারণ মানুষের। বুথে গিয়ে শোনেন, ভোট পড়ে গেছে। ভোট দিতে বেরনোর আগে দোরগোড়ায় বোমা পড়ে।
কী হতো, কলকাতা পুরভোটের দিন যদি এসব কাণ্ড না হতো? ফলাফলের সামান্য হেরফের হতো হয়তো! কিন্তু তৃণমূলের পক্ষেই মানুষের রায় যেত। ভোটের আগের প্রায় সমস্ত সমীক্ষাই সে ইঙ্গিত দিয়েছিল। ঠিক যেমন, ত্রিপুরায় জেতার জায়গায় ছিল বিজেপি। শাসকবিরোধী হাওয়া থাকলেও বিরোধীরা শাসককে হারানোর মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না।
ভোট সত্যি সত্যিই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব। সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বাস করি, শুধুমাত্র ভোট লুঠ করে কারো পক্ষে জেতা সম্ভব হয় না। হাওয়া যখন ঘোরে, তখন শত চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই মানুষ পরিবর্তনের ভোট দেয়। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা সব রাজ্যই দেখেছে সে ঘটনা। কিন্তু সমস্যা হলো, পশ্চিমবঙ্গে যে কায়দায় একদা পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল, যে কায়দায় ত্রিপুরায় পুর নির্বাচন হলো, যে কায়দায় এবারের কলকাতা পুরসভা ভোট হলো, তা আর যা-ই হোক উৎসব নয়। আর এর নাম যদি উৎসব হয়, তাহলে উৎসব না হওয়াই শ্রেয়।
গণতন্ত্রের নামে এমন উৎসব যত হবে, বাকি দেশের সামনে পশ্চিমবঙ্গের, বাঙালির সম্মান তত ভূলুন্ঠিত হবে। সত্যিই কি চাই আমরা তা?