উদ্বাস্তু সমস্যার মোকাবিলায় কতটা সফল ম্যার্কেল
২৫ আগস্ট ২০২০জার্মানিতে দীর্ঘদিন ধরে চ্যান্সেলারের পদে আছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর একটা বাক্যবন্ধ নিয়ে সব চেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। কী সেই কথা? কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জার্মানিতে ১০ হাজার উদ্বাস্তুচলে আসার পর ম্যার্কেল বলেছিলেন, ''হ্যাঁ, আমরাও পারি''। এই কথার মধ্যে নিহিত বাক্যটি হলো, ''উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েও আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।'' এই উদ্বাস্তুরা হাঙ্গেরিতে আটকে পড়েছিলেন। সব চেয়ে বেশি লোক এসেছেন সিরিয়া থেকে। তাছাড়া উত্তর আফ্রিকা, ইরাক, আফগানিস্তান থেকেও অনেকে এসেছেন।
ম্যার্কেল তাঁদের জার্মানিতে ঢুকতে দিয়েছেন। যদিও ডাবলিন চুক্তি অনুসারে ইইউ-র বাকি দেশগুলিরও তাঁদের দায়িত্ব নেয়ার কথা। চুক্তিতে বলা ছিল, ইইউ-র দেশগুলিতে আগে উদ্বাস্তুদের নাম তালিকাভুক্ত করতে হবে, তারপর তাঁরা ঢুকতে পারবেন। কিন্তু ম্যার্কেল আগে উদ্বাস্তুদের ঢুকতে দিয়ে পরে তাঁদের দাবি পরীক্ষা করেছেন।
২০১৫ সালে জার্মানিতে আশ্রয়ের জন্য পাঁচ লাখ লোক আবেদন করেছিল। পরের বছর আরও সাড়ে সাত লাখ। সেই সময়ের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী টমাস ডি মেজিয়ার সরকারি রেডিও এআরডি-র কাছে স্বীকার করেন যে, মুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। তাঁর পর অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী হয়েছিলেন হর্স্ট সেহোফার। তিনি একসময় বলেছিলেন, ''২০১৫ ছিল অন্যায়ের রাজত্ব।''
ম্যার্কেলের রাজনৈতিক বিরোধীরা বরং তাঁর সিদ্ধান্তের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। গ্রিন পার্টির নেত্রী ইরিনে মিহালিক বলেছেন, ''চ্যান্সেলার যে সীমান্ত থেকে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে দেননি, সেটা ঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ, সেটা হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। ইউরোপের কেন্দ্রে সংঘাত তীব্র হতো।''
সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা ও পার্লামেন্ট সদস্য লারস কাত্তেলুচি এই মতের সঙ্গে মোটামুটি একমত। কিন্তু তিনি সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। তাঁর মত হলো, ''জার্মানিরউচিত ছিল ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে আরো আলোচনা করা। এর ফলে জার্মানিকে বিপুল সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে।''
চরম দক্ষিণপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানির নেতা গতফ্রিড কিউরিওর বরং এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি আছে। তাঁর মতে, ''ম্যার্কেল যদি বাস্তবসম্মত ও দায়িত্বশীল হয়ে আইন অনুযায়ী চলতেন তা হলে ঠিক হতো। সকলকে সীমান্ত থেকেই বিদায় করে দেয়া উচিত ছিল। তা হলে কম মানুষ আসতেন। কিছু মানুষ ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরতেন।''
অনুমোদন ও সংশয়
ম্যার্কেলের ওই বাক্যবন্ধ শুনে অনেক লোক তাঁর পক্ষে চলে গেছিলেন। জার্মানির বাইরে তাঁর এই সিদ্ধান্তকে সকলে স্বাগত জানিয়েছেন। ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ''জার্মানি উদ্বাস্তুদের প্রতি খোলা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।'' আল জাজিরার রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ''যাঁরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করছিলেন, তাঁদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে জার্মানি।''
কিন্তু কিছু সন্দিগ্ধ মানুষের বিশ্বাস ছিল, জার্মানি যতটা করতে পারে, তার থেকে অনেক বড় বোঝা নিচ্ছে। অনেকের প্রশ্ন ছিল, এদের জন্য কী করা হবে? ভিন্ন সংস্কৃতির এত লোক এসে গেলে অসুবিধা হবে না? ম্যার্কেলের সিদ্ধান্ত দেশকে দুই ভাগ করে দিয়েছিল।
কাত্তেলুচির দল ম্যার্কেলের নেতৃত্বাধীন জোটে আছে। ফলে এই নীতি রূপায়ণে তাদেরও দায় ছিল। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছে. চ্যান্সেলার যদি আরো বিস্তারিত পরিকল্পনা পেশ করতেন তা হলে ভাল হতো। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন. ''তিনি বলেছিলেন, আমরা কীভাবে এই কাজ করব এবং কাকে কী করতে হবে, তা স্পষ্ট করা হোক। তারপর সমাজে এই নিয়ে চর্চা শুরু হলো। আমাদের নীতির সমর্থক ও বিরোধীরা একে অন্যের প্রতি যে মনোভাব পোষণ করেছিলেন তা বিস্তারিত আলোচনা করলে এড়ানো যেত।''
ম্যার্কেল যে প্রাথমিকভাবে স্বাগত সংস্কৃতি চালু করেছিলেন, সেটা ২০১৫-১৬-র নিউ ইয়ার্স ইভে অনেকটাই ফিকে হয়ে গেল। সেদিন কোলন স্টেশনের কাছে একজন অভিবাসী এক নারীর লাঞ্ছনা করেছিলেন। তার আগে থেকেই উদ্বাস্তু শিবিরে একাধিক আক্রমণ হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষের মনোভাব কীরকম ছিল।
এর ফলে লাভ হয়েছিল এএফডি পার্টির। ২০১৭-র ফেডারেল নির্বাচনে তারা বুন্দেশলিগায় সব চেয়ে বড় বিরোধী দলে পরিণত হয়। তার আগে অনেক রাজ্যে তাদের সমর্থন বিপুলভাবে বেড়ে যায়।
ম্যার্কেল অবশ্য সবসময়ই তাঁর ২০১৫-র সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে এসেছেন। তার থেকে পিছিয়ে যাননি। কিন্তু তিনি ২০১৬-র ডিসেম্বরে সিডিইউ পার্টির সমাবেশে বলেছিলেন, ২০১৫-র গ্রীষ্মকালের মতো অবস্থা যেন আর কখনো না আসে। ২০১৬ থেকে জার্মান সরকার উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক নিয়ন্ত্রিত নীতি নিয়েছিল। অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। তখন থেকে উদ্বাস্তুদের আসা কমে যায়। কারণ, যে বলকান পথ ধরে তাঁরা আসতেন, সেটাও ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।
চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় অপরাধ বাড়তে থাকে। হত্যা, ধর্ষণ, নিগ্রহের সঙ্গে অভিবাসীরা বেশি করে জড়িয়ে পড়ে। তবে এই সব অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা ছিলেন যুবক। তাঁদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা এমনিতেই থাকে।
সেহোফার আগে থেকেই ম্যার্কেলের সিদ্ধান্তের সমালোচক ছিলেন। তবে তিনি মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন। এমনকী তিনি অভ্যন্তরীণ মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
সিডিইউ মুখপাত্র প্যাট্রিক সেনসবার্গের মতে, ''যাঁরা আশ্রয় নিতে আসছে এবং যাঁরা চাকরির খোঁজে আসছেন, তাঁদের মধ্যে ফারাক করা উচিত। তাঁর মতে, উদ্বাস্তুদের সুরক্ষা মানে সাময়িক সুরক্ষা। আর যাঁরা চাকরি পেয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আসছেন, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা দরকার এবং আমাদের মূল্যবোধকে গ্রহণ করতে হবে। ''
জার্মান সমাজ অভিবাসন নীতি নিয়ে বিভক্ত। ৬০ শতাংশ জার্মান মনে করেন, দেশ উদ্বাস্তুদের নিয়ে চলতে সক্ষম। ৪০ শতাংশ ঠিক এর উল্টো মেরুতে আছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেরফ্রেডের মতে, ''২০১৫ সাল জার্মান সমাজে বিভাজন তৈরি করেছিল। রাজনীতিতে এর ফলে চরমপন্থা জনপ্রিয় হয়েছে।''
ম্যার্কেলের বিখ্যাত উক্তির পাঁচ বছর পর জার্মান সমাজ কি সত্যি সত্যি দেখাতে পেরেছে যে, তারা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে? টমাস ডি মেজিয়ার মনে করেন, ''সমাজের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।'' তাঁর দলের সহকর্মী সেনসবুর্গ মনে করেন, ''উদ্বাস্তু সংকটের সমাধানে তাঁরা সফল হয়েছেন।''
জার্মান ইনস্টিটিউট অফ ইকনমিক রিসার্চের সমীক্ষাও একই ধরনের কথা বলছে। তাদের মতে, জার্মানি উদ্বাস্তু সমস্যা মোকাবিলায় সফল। তবে এখনে থামলে চলবে না। যাঁরা জার্মানিতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদেরও একটা দায়িত্ব আছে। আর যাঁরা আশ্রয় দিচ্ছেন, তাঁদের দায়টাও কম নয়।
ক্রিস্টফ হ্যাসেলবাক/জিএইচ/এসজি