উচ্চ প্রযুক্তির জালিয়াতির ফাঁদ পাতা ভারতে
১ অক্টোবর ২০২১মনসারামের নাম খুব বেশি মানুষ শুনেছেন বলে মনে হয় না৷ কিন্তু রাজস্থানের মরুশহর বিকানেরের মনসারাম একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন৷ দিন কয়েক আগে রাজস্থানে শিক্ষক নিয়োগের প্যানেল তৈরির জন্য পরীক্ষা ছিল৷ তাতেই মনসারাম উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্যে এমন একটা টোকাটুকির পন্থা উদ্ভাবন করেছেন, যা আগে কখনো ভারতে অন্তত দেখা যায়নি৷ মনসারাম একটা চটি তৈরি করেছেন, যার সোলের খাঁজে লুকিয়ে আছে মোবাইল ও ব্লুটুথের যন্ত্র৷ পরীক্ষার আগে যাতে তা চালু করা যায়, তার ব্যবস্থাও করেছেন৷ এবার যিনি পরীক্ষা দিতে যাবেন, তিনি শুধু যে ওই চটি পরবেন তাই নয়, কানে লাগাবেন একটা রিসিভার৷ ছোট রিসিভার লুকিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া রাজস্থানের মতো ঢিলেঢালা রাজ্যে খুব একটা শক্ত কাজ নয়৷ রিসিভার কানে লাগিয়ে নেবেন৷ তারপর পরীক্ষা শুরু হলেই, প্রশ্নের জবাব এসে যাবে৷ রিসিভারে জবাব শুনে পরীক্ষার্থী লিখে যাবেন৷
প্রশ্ন হলো, বাইরে বসে কী করে জানা যাবে যে কী প্রশ্ন এসেছে৷ তার ব্যবস্থাও করা ছিল৷ প্রশ্নপত্র পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা দেড়েক আগেই ফাঁস হয়ে যাবে৷ ফলে কোনো অসুবিধাই নেই৷ দুই থেকে ছয় লাখ টাকায় এই চপ্পল ও রিসিভার বিক্রি করেছিলেন মনসারাম ও তার সঙ্গীরা৷ মোট ৫০টা বিশেষ প্রযুক্তির চপ্পল বিক্রি করে তাদের আয় মন্দ হয়নি৷ প্রথমে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল৷ প্রশ্নপত্রও যথাসময়ে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু তাও শেষ রক্ষা হরলো না৷ কারণ, পরীক্ষার দিন সকালে বিকানের থেকে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে৷ তাদের জেরা করে এই ঘটনার কথা জানতে পারে তারা৷ তারপর রাজস্থানের পাঁচটি শহর থেকে ওই চপ্পল পরা পাঁচজন পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১২ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা৷ হাই টেক দুর্নীতি রুখতে এই পন্থাই নিতে হয়েছিল পুলিশকে৷
ভারতে পরীক্ষার হলে হাই টেক দুর্নীতি নতুন নয়, তবে তার রূপবদল হয়েছে৷ ২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায় হাই টেক দুর্নীতি হয়েছিল৷ সেখানে পরীক্ষার্থীর বদলে কোনো পেশাদার চিকিৎসক বা ডাক্তারি পড়ছে এমন কোনো মেধাবী ছাত্র গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসত৷ বোর্ডের দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার ও কর্মকর্তারা পরীক্ষার্থীর এডমিট কার্ডে ছবি বদল করে দিতেন৷ পরীক্ষা হয়ে গেলে আবার সেই ছবি বদল করে পরীক্ষার্থীর ছবি বসানো হতো৷ শুধু তাই নয়, কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী নিজেই পরীক্ষা দিত৷ যে উত্তর তারা জানে সেই উত্তর দিত৷ পরে বোর্ডের কর্মকর্তারা সেই খাতায় বাকি ঠিক উত্তরগুলি বসিয়ে দিত৷ এই ভাবে খুব ভালো নম্বর নিয়ে সে পরীক্ষায় পাস করে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেত৷ কিছু পরীক্ষার্থীকে প্রশ্নপত্র ফাঁসও করে দেয়া হতো৷ আর এসবই করা হতো বিপুল অর্থের বিনিময়ে৷ এর সঙ্গে দালাল, রাজনীতিক, আমলা সহ বিপুল চক্র কাজ করতো৷ এই কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর অনেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ সরকারি মতে সংখ্যাটা ২৫ থেকে ৪০-এর মতো৷ বেসরকারি মতে সংখ্যাটা একশর মতো৷ এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতা কতটা৷
পরীক্ষার ক্ষেত্রে ভারতে আরেকটি হাই টেক দুর্নীতি কিছু বছর আগে ধরা পড়েছিল৷ পরীক্ষার্থীরা বিশেষ কলম নিয়ে যেত৷ সেই কলম দিয়ে প্রশ্নপত্র স্ক্যান করে ব্লুটুথ ব্যবহার করে পাঠিয়ে দিত বাইরে৷ কিছুক্ষণ পর জবাব এসে যেত তাদের কাছে৷ এখন তাই পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে যাওয়া বন্ধ৷ কলেজ শিক্ষকদের প্যানেলে নাম তোলার জন্য নেট পরীক্ষা এখন দিতে হয় কম্পিউটারে৷ অন্য অনেক পরীক্ষাও তাই৷ এখানে কম্পিউটারই উত্তরপত্র চেক করে৷ এই পদ্ধতির নাম হলো অপটিক্যাল মার্ক রেকগনিশন বা ওএমআর৷ শুধু নিজের এডমিট কার্ড ও পরিচয়পত্র ছাড়া কিছুই পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে দেয়া হয় না৷
কিন্তু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেমন নিত্যনতুন উদ্ভাবন হচ্ছে, তেমনই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্নীতির নতুন নতুন পন্থাও গজিয়ে উঠছে৷ আর যেহেতু কিছু পরিবার চাকরির জন্য, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করতে রাজি, তাই শিক্ষাক্ষেত্রে হাই টেক দুর্নীতির রমরমা৷
এর বাইরে হাই টেক দুর্নীতির শিকার হলেন সাধারণ মানুষ, যারা হঠাৎ দেখেন, তাদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কয়েক লাখ টাকার কেনাকাটা হয়ে গেছে৷ দিন দুই আগে আমারই এক প্রতিবেশীর ক্রেডিট কার্ড থেকে আড়াই লাখ টাকার জিনিস কেনা হয়েছে৷ তার কাছে জিনিস কেনার মেসেজ আসার পর তিনি হতবাক৷ যে বা যারা জালিয়াতি করেছে, তারা পিন নম্বর ব্যবহার করে জিনিস কিনেছে৷ কী করে তারা পিন পেল তা ব্যাংক বা পুলিশ কেউই জানায়নি৷ পুলিশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এক মাসের মধ্যে তারা টাকা উদ্ধার করবে৷ ব্যাংক তাকে বলেছে, তিন মাসের মধ্যে তিনি টাকা ফেরত পাবেন৷ কিন্তু আগে তো জালিয়াতরা ধরা পড়ুক৷ পুলিশ বা ব্যাংক এত তৎপর হলে তো এই ধরনের জালিয়াতি করার সাহসই হতো না৷
মাঝখানে দিল্লিতে এটিএম মেশিনে ক্যামেরা বসিয়ে দিত জালিয়াতেরা৷ সেখানে আপনি ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা তুললেই কার্ড নম্বর, পিন নম্বর সব ধরা পড়ে যেত ক্যামেরায়৷ তারপরেই জালিয়াতরা তা ব্যবহার করে টাকা তুলে নিত৷ যে সব ব্যাংকের এটিএমে গার্ড নেই, সেখানে এই জালিয়াতি বেশি হতো৷
ফলে রিজার্ভ ব্যাংককে লাগাতার বিজ্ঞাপন দিতে হয়, দয়া করে কাউকে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের পিন শেয়ার করবেন না৷ তাহলে বিপদ৷ কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, পিন শেয়ার না করেও টাকা বাঁচানো যাচ্ছে না৷ তা হলে উপায়? একদিকে ডিজিটাল পেমেন্টের জন্য উৎসাহ দিচ্ছে সরকার৷ অন্যদিকে ডিজিটাল পেমেন্টের পথে জালিয়াতির ফাঁদ পাতা৷ মানুষ যায় কোথায়? প্রতিবেশীর তো ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে আড়াই লাখ টাকার জিনিস কিনে নিয়েছে জালিয়াতরা৷ এরপর তিনি যদি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বন্ধ করে দেন, তা হলে?
এখন যেমন প্রযুক্তির ফাঁদ পাতা ভুবনে, তেমনই পাতা রয়েছে জালিয়াতদের ফাঁদও৷ জেনে-না জেনে সেই ফাঁদে বিস্তর মানুষ পা দিচ্ছেন বা অজান্তেই ফাঁদে পড়ছেন৷ ফলে সাধু সাবধান৷ যে সাবধানতা নেয়ার দরকার তা নিন৷ তারপরেও উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জালিয়াতরা আপনার পকেট ফাঁকা করবে কি না, করলে সেই টাকা কবে পাবেন, আদৌ পাবেন কি না, সেসব বড় গোলমেলে প্রশ্ন, যার উত্তর সহজে পাওয়া যায় না৷ তাই একটা নিয়ম করা খুবই জরুরি, এভাবে টাকা গেলে গ্রাহকদের টাকা দিতে বাধ্য থাকবে ব্যাংক৷ না হলে, সাধারণ মানুষ এই জালিয়াতদের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হবেন৷