ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশিরা
১১ এপ্রিল ২০১৭জনমনে অনেক আগ্রহ থাকলেও, এই প্রশ্নগুলি নিয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় আলাপ-আলোচনা সচরাচর চোখেই পড়ে না৷ এখানে সঠিক তথ্যের অভাব যেমন আছে, তেমনি আছে জিহাদি সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে ভালো গবেষণার অভাব৷ আরও আছে সরকারি চোখ রাঙানি আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলির মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট৷ এর মাঝেই আমাদের উত্তরগুলি খুঁজে নিতে হবে৷
আইএস-এর তথাকথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদে যোগ দিতে সিরিয়া বা ইরাকে গেছেন এমন ‘হিজরতকারীর' সংখ্যা — বাংলাদেশি, দ্বৈত নাগরিক ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সব মিলিয়ে — ৫০-এর কম হবে না৷ আইএস-এর বাইরে আল-কায়েদা সমর্থক গ্রুপগুলির জন্য লড়াই করতে গেছেন যারা, তাদের হিসেবে ধরলে এই সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে৷
তথাকথিত খুরাসানের জিহাদে যোগ দিতে যারা আফগানিস্তানে গেছেন, তারা এই হিসেবের বাইরে৷ জিহাদি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পাবলিক ডোমেইনে যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তা যাচাই-বাছাই করেই আমি এই সংখ্যাগুলি অনুমান করছি৷
এখানে মনে রাখা দরকার যে, টাকা-পয়সা খরচ করে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যাওয়ার সুযোগ বা সামর্থ্য আছে, এমন লোকজনই কিন্তু দেশের বাইরে হিজরতকারী হয়েছেন৷ খিলাফতে বিশ্বাস করেন, জিহাদ করতে চান কিন্তু বিদেশে হিজরত করতে পারেননি, এমন কয়েক হাজার আইএস-সমর্থক কিন্তু বাংলাদেশেই থেকে গেছেন৷ এদের অনেকেই দেশের ভিতরেই হিজরতকারী হয়েছেন — বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে আস্তানা পেতেছেন৷ এরাই যখন ব়্যাব-পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, তখন তাদের ‘নব্য জেএমবি' বা ‘তামিম-সারওয়ার গ্রুপ' নাম দিয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয়৷
সিরিয়া-ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি৷ এদের মধ্যে তিনজনকে ‘শহিদ,' ‘বীর' ইত্যাদি বিশেষণ লাগিয়ে আইএস-এর বিভিন্ন প্রোপাগান্ডায় উপস্থাপন করা হয়েছে৷
মার্চ মাসের মাঝামাঝি আইএস-এর ফুরাত মিডিয়া একটি ভিডিওটি প্রকাশ করে আবু মরিয়ম আল-বাঙ্গালী নামক এক জিহাদির বক্তব্যসহ৷ এই আবু মরিয়ম ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে ইরাকের টিকরিট শহরের পাশে একটি আত্মঘাতী হামলায় জীবন বিসর্জন দেন৷ তার আসল নাম নিয়াজ মোর্শেদ রাজা৷ চট্টগ্রামের এক বিত্তশালী পরিবারের সন্তান, পড়ালেখা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে৷
নিয়াজ মোর্শেদের আগে আরেক জিহাদির নাম পাওয়া যায় আইএস-এর দাবিক ম্যাগাজিনে৷ আবু জান্দাল আল-বাঙ্গালী নামক এই জিহাদি সিরিয়ার আইন ঈসা শহরের পাশে এক যুদ্ধে মারা যান৷ তার মৃত্যুর কোনো তারিখ জানা যায়নি৷ আবু জান্দালের আসল নাম আশিকুর রহমান জিলানী৷ ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র এই জিলানী, পিলখানা বিদ্রোহের সময় নিহত কর্নেল মশিউর রহমানের ছেলে৷
মোর্শেদ আর জিলানীরও আগে আইএস-এর হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান আবু দুজানা আল-বাঙ্গালী (অন্য অনেকেই এই কুনিয়া বা ছদ্মনামটি ব্যবহার করেন)৷ এই আবু দুজানাই সম্ভবত আইএস-এর প্রথম বাংলাদেশি সদস্য৷ শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশ থেকে লেবানন যাওয়ার পথে সন্দেহভাজন জিহাদি হিসেবে ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন তিনি৷ এরপর মসুল শহরের পাশে বাদোশ কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় সহবন্দীদের কাছ থেকে আইএস-এর আদর্শের দীক্ষা নেন৷ এই আবু দুজানার কথা ফুরাত মিডিয়ার একটি বাংলা ভিডিওতে বলা হলেও তার আসল নাম, পরিচয় ইত্যাদি এখনও জানা যায়নি৷
‘শহীদ' বা ‘বীর' তকমা পাননি, কিন্তু আইএস-এর শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন আবু খালেদ আল-বাঙ্গালী৷ তার আসল নাম সাইফুল হক সুজন৷ আইএস-এর ‘বাংলাদেশ ক্লাস্টারের' মূল নেতা এই আবু খালেদ আইএস-এর ‘টপ হ্যাকার' হিসেবেই কুখ্যাত ছিলেন৷ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সিরিয়ার রাক্কা শহরে আইএস-এর সদরদপ্তরের পাশেই এক মার্কিন ড্রোন হামলায় মারা যান তিনি৷
তবে ‘বাংলাদেশ ক্লাস্টারের' অন্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা কিন্তু বেঁচেই আছেন৷ এই ক্লাস্টারে আছেন সাজিত দেবনাথ ওরফে মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, এটিএম তাজউদ্দীন কাওসার, তাহমিদ রহমান শফিসহ অন্তত ১০ জন বাংলাদেশি বা বাঙালি৷ এদের অনেকেই আইএস-এর ‘ইমনি' নামক সিক্রেট অপারেশন্স গ্রুপের সদস্য৷ এদেরই একজন বাংলাদেশে তথাকথিত খিলাফার সৈনিকদের আমীর আবু ইব্রাহীম আল-হানিফ৷ এক কুর্দিশ গোয়েন্দা সূত্রমতে রাক্কা শহর থেকে একটু দূরে তবকা বাঁধের পাশেই এক সময় আস্তানা ছিল এই বাংলাদেশ ক্লাস্টারের৷ সেখান থেকেই তারা বাংলাদেশে গুলশান হামলাসহ বিভিন্ন হামলা পরিচালনা করেছিলেন৷ বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আইএস-এর নামে যে হামলাগুলি হবে তার নির্দেশনাও কিন্তু আসবে এদের কাছ থেকেই৷
অর্থাৎ বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট নামক যে জিহাদি রাক্ষসটি ত্রাস ছড়াচ্ছে তার মাথাটি কিন্তু বাংলাদেশে নেই৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন মন্তব্যে৷