1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইসরায়েলের জন্য জার্মান ক্ষতিপূরণের ৬০ বছরপূর্তি

৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১

মানবজাতির ইতিহাসে ঠাণ্ডা মাথায় প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের নিধনযজ্ঞের ঘটনা একমাত্র নাৎসি জার্মানিতেই ঘটেছিল৷ তারই জের ধরে জার্মানি ও ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু থেকেই অভিনব এক আকার নিয়েছে৷

https://p.dw.com/p/12jWZ
ছবি: picture-alliance/dpa

অতুলনীয় বর্বরতা

হিটলারের জার্মানি সুপরিকল্পিতভাবে যে ইহুদি নিধন যজ্ঞ চালিয়েছিল, ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই৷ শুধু ইহুদি ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে কিছু মানুষকে বেছে নিয়ে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করার মত ভয়াবহ কুকাজ কেউ কখনো করে নি৷ আর্থিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত সম্ভব না হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেডারেল জার্মানি ইউরোপ ছেড়ে যাওয়া ইহুদি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ১৯৫১ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর ফেডারেল জার্মানির প্রথম চ্যান্সেলার কনরাড আডেনাউয়ার ইসরায়েলের সঙ্গে এই মর্মে এক চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ প্রায় ৬ দশক আগে সেই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল৷ সেদিন আডেনাউয়ার জার্মান সংসদের নিম্ন কক্ষ বুন্ডেসটাগে দেওয়া এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘জার্মান জনগণের নামে অকথ্য অপরাধ করা হয়েছে, যার নৈতিক ও বৈশ্বিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া আমাদের কর্তব্য৷ ফেডারেল জার্মান সরকার ইহুদি সম্প্রদায় ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বৈশ্বিক ক্ষতিপূরণের সমস্যার সমাধানসূত্রে আসতে প্রস্তুত৷ এর মাধ্যমে আমরা মানুষের অসীম কষ্ট ও বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব করার পথে অগ্রসর হতে পারি৷''

কঠিন আলোচনা প্রক্রিয়া

এই ভাষণের প্রায় ৬ মাস পর তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি ও ইসরায়েলের মধ্যে এবিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে নেদারল্যান্ডস'এর ভূখণ্ডে এই ‘ক্লেমস কনফারেন্স' অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ এর ছত্রছায়ায় মোট ২২টি ইহুদি সংগঠন ইসরায়েলের বাইরে বসবাসরত ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল৷ খুঁটিনাটি বিষয়গুলি নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক ও দর কষাকষির পর পশ্চিম জার্মানি ইসরায়েলকে ৩০০ কোটি ডয়চে মার্ক মূল্যের পণ্য দিয়েছিল৷ ‘ক্লেমস কনফারেন্স'এর সংগঠনগুলি পেয়েছিল ৪৫ কোটি মার্ক৷

মিউনিখের ইতিহাসবিদ হান্স গ্যুন্টার হকার্টস এপ্রসঙ্গে বললেন, ‘‘একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড স্থির করাই ছিল বড় এক সমস্যা৷ আলোচনার সময় ইসরায়েলের সংসদের সামনে তোলপাড় কাণ্ড চলছিল৷ অনেকের হাতে বিশাল পোস্টার দেখা গেছে, যাতে লেখা ছিল – আমাদের নিহত বাপ-দাদাদের মাথাপিছু মূল্য কত হওয়া উচিত? অবশ্যই এর কোনো মানদণ্ড থাকতে পারে না৷ অতএব যুক্তি খাটিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্য এক মানদণ্ড স্থির করা হয়েছিল৷ যেসব ইহুদি হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেয়ে ইসরায়েলে নতুন জীবন শুরু করছে, তাদের ব্যয়ভার জার্মানির উপর চাপানো হলো৷ সেসময়ে ইসরায়েলের ডয়চে মার্কের প্রয়োজন ছিল না, তারা চাইছিল জার্মানিতে উৎপাদিত শিল্পসামগ্রী – যেমন রেল ইঞ্জিন, জাহাজ ইত্যাদি৷ তাছাড়া রাসায়নিক উপকরণ ও ওষুধও দেওয়া হয়েছিল৷''

Auschwitz-Monowitz IG Farben
হিটলারের জার্মানি সুপরিকল্পিতভাবে যে ইহুদি নিধন যজ্ঞ চালিয়েছিল, ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেইছবি: picture-alliance/dpa

বাস্তবসম্মত নীতি

এই চুক্তি রূপায়ণের ক্ষেত্রে আডেনাউয়ার'এর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হান্স গ্লবকে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ অথচ এই গ্লবকে নাৎসি জমানায় ইহুদি বিদ্বেষের অনেক আইনের রচয়িতা ছিলেন৷ ইসরায়েল অবশ্য তার বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি জানায় নি৷ কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানির প্রতি ইসরায়েলের মানুষ কি কৃতজ্ঞ হতে পেরেছিলেন? ইসরায়েলের লেখক ও ঐতিহাসিক টম সেগেভ মনে করেন, ইসরায়েল সেময়ে বাস্তবতার ভিত্তিতে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফেডারেল জার্মানি যে উদীয়মান শক্তি হয়ে উঠছে, ইসরায়েল তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল৷ আডেনাউয়ার'এর সরকার যাতে অপমানিত না হয়, ইসরায়েল সেদিকে নজর রেখেছিল৷ ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন এমনকি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে ‘জার্মান' ও ‘নাৎসি' শব্দ দুটিকে কখনো মিলিয়ে না ফেলা হয়৷

ডাভিড বেন গুরিয়ন ও কনরাড আডেনাউয়ার – দুই নেতাই নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে অগ্রসর হচ্ছিলেন৷ আডেনাউয়ার জার্মানিকে আবার পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে একাত্ম করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন৷ সেক্ষেত্রে ইহুদিদের ক্ষতিপূরণ ছিল একটা বড় পূর্বশর্ত৷ অন্যদিকে বেন গুরিয়ন তখন দ্রুত গতিতে তাঁর নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত৷ জার্মানি একদিকে যেমন দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, তেমনই ব্যক্তিগত ভিত্তিতেও আলাদা করে ইসরায়েলি নাগরিকদেরও আলাদা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে৷ ১৯৫৬ সালের এক জার্মান আইনের আওতায় অনেক ইসরায়েলি নাগরিক নির্দিষ্ট আবেদনের ভিত্তিতে নিজেদের অধিকার হিসেবে বিশাল অঙ্কের অর্থ পেয়েছেন, যা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে পাওয়া অর্থের চেয়ে অনেক গুণ বেশি৷ ২০০০ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলি নাগরিকরা জার্মানির কাছ থেকে মোট ৮,৩০০ কোটি মার্ক পেয়েছিলেন৷ তবে বিভিন্ন কারণে এই ক্ষতিপূরণ দুই দেশেই চরম বিতর্কের কারণ হয়ে ছিল৷ সাবেক পূর্ব জার্মানিও কোনোদিন নাৎসি জমানার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে ইসরায়েলকে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয় নি৷

প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন

সম্পাদনা: আরাফাতুল ইসলাম