ইরানে নারী-পুরুষের সাম্য কেবল ‘নির্যাতনে'
৩০ অক্টোবর ২০২২ডয়চে ভেলে: কারাবাসের অভিজ্ঞতাকেমন ছিল?
মনিরেহ বারাদারান: ১৯৮১ সাল ছিল সবচেয়ে খারাপ সময়৷ এটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো৷ আমাকে নির্যাতন করা হতো৷ অন্যদের নির্যাতন করতে দেখেছি৷ একটা নিয়মিতই করা হতো, নৃশংসভাবে করা হতো৷ অত্যাচার করা হতো, চাবুক মারা হতো, হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো৷ আমার হাত পেছনে বেঁধে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হতো৷ এক হাত বাঁধা হতো উপরে, অন্য হাত নীচ থেকে৷ এটা খুবই খারাপ ছিল৷ মানসিক নির্যাতনও করা হতো৷ সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, নড়চড়াও করা যেত না, ঘুমাতে দেয়া হতো না৷
গণহারে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ আমার ভাইকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল৷ আমরা তখন সেই গুলির শব্দ শুনতে পেতাম৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, তখন কেবল চার মাসের মধ্যে চার হাজার বা তারও বেশি মানুষকে গুলি করা হয়েছিল৷
এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের ঘটনাকে ভয়াবহ বলেই ধরে নেয়া যায়৷ খুবই উদ্বেগজনক, ইভিনসহ অনেকেই কারাগারে বন্দি রয়েছে৷ আমার জন্য এঠা আবার সেই দুঃস্বপ্ন ফিরে আসার মতোই৷
এটা নৃশংসতা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে৷তখনও কি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো?
যৌন নিপীড়ন ছিল, কিন্তু এর মানে ধর্ষণ হতো, তেমনটা নয়৷ আমি নিজেও ধর্ষণের শিকার হইনি৷ বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতো, আমরাও শুনেছি৷ তবে একনায়কতন্ত্রের অধীনে রাষ্ট্র, যেমন আর্জেন্টিনা বা চিলির মতো পদ্ধতিগত ধর্ষণ করা হতো না৷ কিন্তু শারীরিক ও মৌখিক লাঞ্ছনা, নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো৷
নারীকে সাধারণত কীভাবে দেখা হয়?
নারী হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে আপনি একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ৷ অর্থাৎ, একজন পুরুষের সমান মূল্য নেই আপনার৷ কিন্তু যখন অত্যাচার এবং মৃত্যুদণ্ডের কথা আসে, তখন আপনি পুরুষের সমান৷ এই মতাদর্শ অনুসারে, প্রতিবাদী নারীদের শিশুদের মতো শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা করা হয়৷ কিন্তু নারীদের এই শিক্ষিত করে তোলার প্রক্রিয়াটি খুব খারাপ ছিল৷
যেমন, শুধু নারীদের জন্য বিশেষ এক ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম আমি৷ যে নারীরা প্রতিবাদ করেছিল, তাদের পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল৷ সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস আমরা বাইরের কিছুই দেখতে পাইনি, শুনতে পাইনি৷ সারাক্ষণ আমাদের বসিয়ে রাখা হতো৷ এটা খুবই খারাপ ছিল এবং এটাই ছিল আমাদের পুনর্শিক্ষিত করার প্রক্রিয়া৷
মানুষ কি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে? মানসিক দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে কি পরবর্তীতে আপনার অনেক সময় লেগেছে?
আমার অনেক নারী বন্ধুকে চিকিৎসা করাতে হয়েছে৷ যখন আমার মনে পড়ে যে আমরা কীভাবে বেঁচে ছিলাম, তখন আমি অন্যদের যন্ত্রণা অনুভব করি৷ আমি তিন বার নির্জন কারাবাসে মাসের পর মাস সময় কাটিয়েছি৷ তবে এই একতাবোধ, সংহতিবোধ অনেক সাহায্য করেছে৷ নিজের সব দুঃসহ স্মৃতি লিখে রাখা শুরু করার পর আমি ভিন্ন মানুষ হয়ে উঠেছি৷
আপনি বললেন যে আপনি এখনও ভয় পাচ্ছেন, কারণ অনেক নারীকে কারাগারে নেয়া হচ্ছে৷ আপনি কি মনে করেন পরিস্থিতি আগের মতোই খারাপ হবে?
মাঝেমধ্যেই আমি ভয় পাই যে এমনটাই ঘটবে৷ এই বন্দিরা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বন্দি৷ আমি আশা করি যে তারা ১৯৮০ এর দশকের মতো মৃত্যুদণ্ড দেবে না৷ যদি তারা এমনটা করতে শুরু করে, তাহলে আবার সেই অন্ধকার যুগ ফিরে আসবে৷ আমি আশাবাদী, কারণ সময় বদলেছে৷ কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতার কারণেই এই ভয়টা আমার আছে৷
ইরানের বর্তমান আন্দোলনকে আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করি৷ মানুষ আইনে পরিবর্তন আসার জন্য অপেক্ষা করছে না- তারা জানে যে পর্দাপ্রথা, নারী-পুরুষের বিচ্ছিন্নতার মতো এই ইসলামি আইন কখনোই পরিবর্তন হবে না৷ এজন্য তারা নিজেরাই আইন অমান্য করছে৷ যেভাবে তারা তাদের হিজাব খুলে ফেলছে এবং প্রকাশ্যে নাচছে, সেটা খুবই সুন্দর৷ এই স্বপ্ন সবসময়ই ছিল এবং এখন এটি বাস্তবে রূপ নিচ্ছে৷ এটাই এই আন্দোলনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এটা আমাকে আশা দেখাচ্ছে৷
যদি আবারও গণহারে মানুষকে জেলে বন্দি করা শুরু হয়, তাহলে এর পরিণতি কী হবে?
এর ফলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে৷ এখন পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণ ছিল এবং সহিংসতার আশ্রয় নেয়নি৷ কিন্তু ক্ষোভ তীব্র হলে রক্ত ঝরতে পারে৷ আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের গতি স্তিমিতও হয়ে যেতে পারে৷
তাই জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে আমার আবেদন, আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকলে তারা ১৯৮০-এর দশকে যা করেছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে না৷
মনিরেহ বারাদারান একজন লেখক, সমাজবিজ্ঞানী এবং মানবাধিকারকর্মী৷ ইরানের কারাগারে থাকাকালীন সময়ের স্মৃতি নিয়ে আত্মজীবনী ‘এরভাখেন আউস ডেম আল্বট্রাউম' (দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠা) লিখেছেন তিনি৷ এই বইটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে৷ ১৯৯৯ সালে বারাদারান কার্ল ফন ওসিটৎস্কি মেডেল পেয়েছেন৷