ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের এ কেমন কৌশল
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২অথচ এর মধ্যে তিনটি রাজনৈতিক দল সরাসরি ইভিএমের বিরুদ্ধে বলেছে৷ ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ইভিএম নিয়ে কি অপকৌশলে জড়াচ্ছে নির্বাচন কমিশন?
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য রোডম্যাপে সঠিকভাবে উঠে আসেনি৷ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের ব্যপারে আমরা যে রাজনৈতিক দল ও তাদের কারিগরি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ করেছি তার পূর্ণাঙ্গ অডিও এবং ভিডিও আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে৷ তাদের অডিও এবং ভিডিওতে থাকা বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে৷ সেখানে যদি কারো বক্তব্য সঠিকভাবে প্রতিফলিত না হয় এবং তারা সেটি আমাদের অবহিত করে তাহলে নির্বাচন কমিশন অবশ্যই সেই বক্তব্যগুলো পুনরায় পরীক্ষা করে দেখবে৷’’
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে৷ তারা লিখিত বক্তব্য দিয়েছে৷ কিন্তু নির্বাচন কমিশন দেখিয়েছে, তারা ইভিএমের পক্ষে৷ তাদের বক্তব্য নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে পাল্টে গেছে৷ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এম এ মতিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে আমরা লিখিত বক্তব্য দিয়েছি৷ এখন যদি নির্বাচন কমিশন আমাদের বক্তব্য পাল্টে দেয়, তাহলে তারা সঠিক কাজ করেনি৷’’
এই ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের প্রতি আপনাদের আস্থা অটুট থাকবে কিনা জানতে চাইলে জনাব মতিন বলেন, ‘‘আমরা এখনই কিছু বলবো না৷ তারা তো নতুন এসেছে৷ আমরা আরো কিছুদিন তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবো৷ তারপর এ বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরবো৷’’
নির্বাচন কমিশন রোডম্যাপে যে যুক্তি দেখিয়েছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে থাকায় তারা সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সংলাপে ২৯টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছে, এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, তরিকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল এবং বিকল্পধারা সরাসরি ইভিএমের পক্ষে বলেছে৷ তরিকত ও সাম্যবাদী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক৷ বিকল্পধারার সঙ্গে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমঝোতা ছিল৷
নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে৷ সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জালাল উদ্দীন আহমদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংলাপে আমরা বলেছি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালট পেপারের মাধ্যমে করতে হবে৷ তার অর্থ হলো আমরা ইভিএমের পক্ষে নই৷ নির্বাচন কমিশনের প্রকাশনায় যদি আমাদের ইভিএমের পক্ষে বলা হয়, তাহলে তারা সত্যি কথা বলেনি৷ তাহলে তো তাদের উপর আমাদের আর আস্থা থাকবে না৷ তারা তো আমাদের বলেছিল, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গুরুত্ব দেওয়া হবে৷ এখন দেখছি, সেটাও তারা করেনি৷’’
এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ইভিএমের পক্ষে থাকলেও তা শর্ত সাপেক্ষে৷ কিন্তু নির্বাচন কমিশন শর্তগুলো বাদ দিয়েই তারা ইভিএমের পক্ষে বলে উল্লেখ করেছে৷ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যে শর্তগুলো দিয়েছিলাম, সেখানে আমরা বলেছিলাম ইভিএম নিয়ে জনমনে অনাস্থা ও সংশয় আছে৷ ইভিএম ‘হ্যাক' করা যায় না বলে ইসি যে দাবি করছে, তা প্রমাণিত নয়৷ পাশাপাশি কক্ষের দায়িত্ব পালন করা পোলিং অফিসারের হাতে যে ১০ বা ১৫ শতাংশ ভোটারকে নিজের ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটা বাতিল করতে হবে৷ এসব শর্ত পূরণ না করলে ইভিএমের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না৷ এখন তো ভোটের ১৪ মাস বাকি৷ আমরা আমাদের কথাগুলো বলেই যাবো৷’’
ইভিএম নিয়ে যে এত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, সেটা কতটা যৌক্তিক? এ প্রশ্নের জবাবে বুয়েটের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইভিএম নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, সেখানে কিন্তু কেউ এখন প্রমান করতে পারেনি এটা ত্রুটিপূর্ণ৷ আমরাই তো প্রথম ইভিএম তৈরি করেছিলাম, এখন যদিও উন্নত সংস্করণ এসেছে৷ তবে হ্যাঁ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, ইভিএমে ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল বা ভিভিপিএটি নেই৷ ভিভিপিএটি হচ্ছে, ভোটার ভোট দেওয়ার পর ইভিএম থেকে একটি কাগজ বেরিয়ে আসবে৷ সেখানে কারো পরিচয় থাকে না৷ এতে ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা দেখতে পাবেন৷ তবে কাগজটি ভোটার নিতে পারবেন না৷ এটা যুক্ত করা গেলে বিতর্কমুক্ত করা সম্ভব৷’’
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে ইসি৷ এখন তারা বলছে, যন্ত্রটির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি করতে হবে৷ এর আগে গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শেষ দিনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না৷ তবে বুধবার নিজেদের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ অনুষ্ঠানে ইসি দাবি করেছে, সংলাপে বেশির ভাগ দলের মত ইভিএমের পক্ষে থাকায় এটি ব্যবহার না করা যুক্তিসংগত হবে না৷
গত ৬ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে দেশের ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমব্যবহার না করার আহ্বান জানান৷ তারা ইভিএম ব্যবহারে ইসির নেওয়া সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলেও উল্লেখ করেন৷ বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইভিএম কিনতে বিপুল ব্যয় (প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা) কতটুকু যৌক্তিক, তা ভেবে দেখারও অনুরোধ জানান৷
রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পাল্টে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিবৃতিদাতাদের একজন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যদি রাজনৈতিক দলের মতামত পাল্টে দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা প্রতারণামূলক কাজ, কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ এটা তাদের আরো খতিয়ে দেখা দরকার৷ কেন এমনটি হলো? এটার দায়ও নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে৷ এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে এটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অমর্যাদা৷ নির্বাচন কমিশন ইভিএমের ব্যাপারে যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে মনে হয়েছে এটি তাদের পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত৷ তারা তাদের মতামত রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷’’