ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া কিছু অহিংস, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন
দাবি আদায়ে রাজপথের আন্দোলনে প্রায়ই দেখা যায় সহিংস ঘটনা৷ কিন্তু ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া সহিংসতামুক্ত অন্দোলনও কম নয়৷
অহিংস আন্দোলন
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধীকে বলা হয়ে থাকে অহিংস আনোদলনের জনক৷ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অহিংস দর্শনের কারণে তিনি নিজেও ঠাঁই করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়৷ তার অহিংস আন্দোলনে নীতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে গান্ধীর জন্মদিন, অর্থাৎ প্রতি বছরের ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেব পালন করে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো৷
অসহযোগ আন্দোলন
অসহযোগ আন্দোলন হলো গান্ধীর নেতৃত্বে প্রবর্তিত ও পরিচালিত ভারতের একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এই আন্দোলন ভারতব্যাপী সাফল্য অর্জন করতে শুরু করে। ছাত্র-ছাত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষ দেশব্যাপী গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে যোগদান করে৷ অবশ্য এক পর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নিলে ১৯২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অসহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন মহাত্মা গান্ধী৷
লবণ কুচকাওয়াজ
মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে উপমহাদেশে উল্লেখযোগ্য অহিংস আন্দোলনগুলোর আরেকটি হলো লবণ কুচকাওয়াজ৷ এটি হলো ভারতে ব্রিটিশদের একচেটিয়া লবণ নীতির বিরুদ্ধে একটি অহিংস করপ্রদানবিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। সমর্থকদের সাথে নিয়ে তিনি প্রায় ২৩০ কিলোমিটার পদযাত্রা করেন৷ আরব সাগরের তীরে গিয়ে তিনি হাতে লবণ নিয়ে প্রতিবাদ দেখান৷
লুথার কিং ও সিভিল রাইটস মুভমেন্ট
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ছিলেন বিখ্যাত আফ্রিকান-অ্যামেরিকান মানবাধিকার কর্মী। অ্যামেরিকায় নাগরিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। ২৮ আগস্ট ১৯৬৩ সালে তার নেতৃত্বে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ৷
ম্যান্ডেলার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন
বিশ্বের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ইতিাহাসে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নাম উল্লেখযোগ্য৷ ১৯৫৫ সালে এএনসির ‘স্বাধীনতার সনদ’ প্রণয়নে মূল ভূমিকা ছিল ম্যান্ডেলার। সেই সনদে বলা হয়, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা তাদেরই, যারা সেই দেশের জনগণ। দক্ষিণ আফ্রিকা কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ সবার। তবে এক পর্যায়ে এই আন্দোলনটি অবশ্য আর অহিংস থাকেনি৷ বর্ণভিত্তিক আন্দোলন বন্ধে আইন করা হলে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়।
তিয়েনআনমেন স্কয়ার বিক্ষোভ
চীনে গণবিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে ১৯৮৯ সালের এপ্রিল মাসে। কমিউনিস্ট সরকারের দুর্নীতি বন্ধ ও গণতন্ত্রের দাবিতে বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছিলেন প্রতিবাদের অগ্রভাগে। তারা ঐতিহাসিক তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনশন শুরু করেন। আন্দোলন দমাতে এক পর্যায়ে তাদের উপর চড়াও হয় পুলিশ৷ সরকারের নিপীড়ণে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে দাবি অনেকের৷ ছবিতে এক ব্যক্তিকে ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে৷
গান গেয়ে প্রতিবাদ
ইউরোপের দেশ লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ার নাগরিকেরা রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা আদায়ের দাবিতে জাতীয় সংগীত ও দেশাত্মকবোধক গান গেয়ে এই আন্দোলনটি করেছিলেন, যা ইতিহাসে ‘সিংগিং রেভোলিউলশন’ নামে পরিচিত৷ ২৩ আগস্ট ১৯৮৯ সালে ৭ লাখ এস্তোনিয়ান, প্রায় ৫ লাখ লাটভিয়ান এবং প্রায় দশ লাখ লিথুয়ানিয়ান হাতে হাত রেখে এই প্রতিবাদটি করেন৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে ২০১৯ সালে দিনটি উদাযাপন করছেন এস্তোনিয়ার নাগরিকেরা৷
‘ইরাকে হামলা বন্ধ কর’
২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক আক্রমণ করছিল, তখন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরাধেীরা রাস্তায় নেমেছিল৷ এর মধ্যে ইটালির রোমেই জড়ো হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ মানুষ৷ তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য স্পেনসহ আরো কয়েকটি দেশে লাখ লাখ মানুষ প্রতিবাদে জড়ো হয়েছিলেন৷ ২০১৫ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদের ছবি এটি৷
ইউক্রেনের কমলা বিপ্লব
২০০৪ সালে কমলা রংয়ে ছেয়ে গিয়েছিল কিয়েভের রাজপথ৷ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি নির্মূল – এসব দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে লাখো মানুষ জমায়েত হয়েছিল ইউক্রেনের রাজপথে৷ ইউক্রেনীয়দের এই আন্দোলনটি ঠাঁই করে নিয়েছিল ইতিহাসে৷
ভারতে কৃষক আন্দোলন
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে কৃষকেরা৷ দাবি আদায়ে, ২৫ নভেম্বর ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলনের ডাক দেন কৃষকেরা৷ দিল্লিতে ঢোকার মুখে হরিয়ানায় পুলিশ তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে৷ পরে দিল্লিতে অবস্থান কর্মসূচি পালনের অনুমতি পায় কৃষকেরা৷ কৃষকদের দাবির মুখে এক পর্যায়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে কৃষি আইন বাতিল করে বিজেপি সরকার৷
আরআর/এসিবি (এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, বাংলাপিডিয়া, ন্যশনাল জিওগ্রাফিক, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর নন ভায়োলেন্ট কনফ্লিক্ট)