ইউরোপে সুযোগ যথেষ্ট, আগ্রহীদের সচেতনতা অল্প
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১এক সময় ডিভি ভিসা দিয়ে বাংলাদেশিদের মাঝে অ্যামেরিকা যাওয়ার ব্যাপক প্রবণতা ছিল৷ এখন বাড়ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রবণতা৷ শিক্ষা, উন্নত জীবন এবং ভালো আয়ের জন্যই এই প্রবণতা৷ কিন্তু অনেকেই না জেনে অবৈধভাবে বা দালালদের মাধ্যমে বিকল্প পথে, বিশেষ করে তৃতীয় দেশ হয়ে সমুদ্র পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢোকার চেষ্টা করে নিজেরা বিপদে পড়ছেন, দেশের সুনামও ক্ষুন্ন করছেন৷
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইটালিতেই বৈধভাবে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি গিয়েছেন৷ এই সংখ্যা সরকারি হিসবে ৫০ হাজারের মতো৷ যুক্তরাজ্যে গেছে ১৫ হাজারের মতো৷ তার বাইরে অনেক দিন ধরেই সিলেট অঞ্চলের অনেক লোক সেখানে অভিবাসী হয়েছেন৷ গত দুই-তিন বছরে এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢুকে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন৷ ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান জানান, ‘‘এরকম অ্যাসাইলাম সিকার আছেন ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, সাইপ্রাসহ আরো কিছু দেশে৷ সবচেয়ে বেশি আছে ইটালিতে, ৩০ হাজার৷ অন্যান্য দেশে আছে ১০-১৫ হাজার করে৷’’
২০১৭ সালে ইইউ তাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশের সাথে স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি সই করে৷ শরিফুল হাসান জানান, শুধু গত বছরই সমুদ্র পথে অবৈধ চার হাজার ৪২১ জন বাংলাদেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন৷
বৈধ সুযোগ
অভিবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন৷ তিনি পড়াশুনাও করেছেন ইংল্যান্ডে৷ তিনি জানান, ‘‘ইউরোপের মধ্যে বেস্ট হচ্ছে ইংল্যান্ড৷ সেখানে এখন পাঁচ বছরে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়৷ বাবা-মা বাংলাদেশি হলেও সেখানে জন্ম নেয়া তাদের সন্তানরা এখন সহজেই ব্রিটিশ পাসপোর্ট পেয়ে যেতে পারে৷ পড়াশুনা করতে গিয়ে চার বছর থাকার পর কোনো চাকরিতে ঢুকলে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়৷ আর বাংলাদেশি টাকায় দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে নাগরিকত্ব অল্প সময়েই পাওয়া যায়৷’’
পর্তুগাল ও গ্রিসও বিনিয়োগ ক্যাটাগরিতে নাগরিকত্বের সুযোগ দিচ্ছে৷ সেখানে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ দেখাতে হয়৷ এই বিনিয়োগ বাড়ি কেনা বা অন্য কোনো খাতে হতে পারে৷ তবে এত টাকা ব্যবসায়ী বা ধনী ছাড়া সম্ভব নয়৷ যাদের দ্বিতীয় একটা পাসপোর্ট দরকার হয় তারা এই সুযোগ নেন৷ ফলে পড়াশুনা করতে গিয়ে নাগরিত্ব নেয়াই সহজ৷ অনেক কম খরচ৷ আর ইটালিতে অনেক বছর কাজ করতে করতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে৷
জার্মানিতে পড়াশুনার জন্য যাওযার সুযোগ আছে৷ তবে জার্মান ভাষা জানতে হয়৷ তবে ওখানে নাগরিকত্ব পাওয়া এত সহজ নয়৷
ইউরোপের দেশগুলোতে শিক্ষিত এবং দক্ষ লোকের জন্য কাজ আছে৷ তারা সহজেই রেসিডেন্ট পারমিট পায়, নাগরিকত্বও পায়৷
যারা নানা কাজ আর উচ্চ বেতনের কথা বলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে লোক পাঠায়, তারা আসলে নিজেরাই জানে না ওইসব দেশে কোন ধরনের লোকের কাজের বা থাকার-সুবিধা আছে৷ তারা আসলে পুরো কাজটাই করে প্রতারণার জন্য৷ মানুষকে ঠকিয়ে টাকা আয় করার জন্য৷
যারা জানেন, তারা নিজেরাই সব কাগজপত্র ঠিকমতো দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেতে পারেন৷ কাজ পেতে পারেন৷ কোনো দালাল ধরার দরকার নেই৷ বিষয়গুলো বোঝার জন্য বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েব সাইট খেকে তথ্য নিতে পারেন৷ দূতাবাস থেকে নিতে পারেন৷ অথবা অভিজ্ঞ কারুর সহায়তা নিতে পারেন৷
ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন জানান, ‘‘ব্রেক্সিটের কারণে এখন ইংল্যান্ডে বাংলাদেশিদের জন্য অভিবাসন আরো সুবিধাজনক হয়েছে৷ ব্রেক্সিটের আগে ইউরোপীয়, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপীয় অনেক দেশের নাগরিক ইংল্যান্ডে নানা ধরনের কাজে যুক্ত ছিল৷ বাংলাদেশিদের অনেকেই সেখানে গিয়ে কাজ পেতেন না৷ রাস্তায়ও ঘুমাতে হয়েছে৷ কিন্তু ব্রেক্সিট হওয়ায় পর ইউরোপীয়রা সব চলে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশিদের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে৷ তারা কাজ পাচ্ছেন৷’’
বাংলাদেশি যারা ইংল্যান্ডে যায়, তারা মেটামুটি শিক্ষিত৷ প্রচুর খাটতে পারে৷ ফলে তাদের সুনাম আছে৷ ইটালিতেও বাংলাদেশিদের কাজের সুনাম আছে৷
ইটালিতে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করে নেয়া হচ্ছে৷ বিশেষ করে কৃষিখাতে এখন তাদের লোক প্রয়োজন৷ এটাও বাংলাদেশিদের জন্য একটা সুযোগ৷
ইউরোপের বাইরে ক্যানাডা এবং অষ্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ থেকেই আবেদন করে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়৷ পয়েন্ট সিস্টেম আছে৷ নানা দক্ষতা এবং অবস্থার জন্য পয়েন্ট নির্ধারণ করা আছে৷ ছয় মাসের মধ্যেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায়৷ তারপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর ওই দেশে গিয়ে থাকতে হয় নাগরিকত্ব বহাল রাখার জন্য৷ ক্যানাডায় তিন বছরের মধ্যে আর ইউরোপের দেশগুলোতে পাঁচ বছরের মধ্যে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়৷
এশিয়ায় আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায়ও বিনিয়োগকারী হিসেবে বৈধ অভিবাসনের সুযোগ আছে৷ আরব আমিরাতে মাত্র পাঁচ হাজার ডলারে রেসিডিন্ট পারমিট পাওয়া যায়৷
সাবরিনা জেরিন বলেন, ‘‘না জেনে, না বুঝে ঝাঁপ দেয়া ঠিক না৷ নিজের দক্ষতা আর যোগ্যতা বিবেচনা করেই ইউরোপে অভিবাসী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে৷ অবৈধভাবে প্রবেশ করলে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে৷’’
পৃথিবীর যে সব দেশেই অভিবাসন প্রক্রিয়া কোনো গোপন বিষয় নয়৷ দূতাবাসের ওয়েবসাইট ও পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েব সাইটে তা দেয়া থাকে৷ অভিবাসন বিভাগ থেকেও তা জানা যায়৷ অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, ‘‘সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ, যারা ইউরোপে যেতে চান, তার ইংরেজি পড়তে পারেন না বা বুঝতে পারেন না৷ আবার অন্যান্য বিদেশি ভাষাও তারা জানেন না৷ ফলে এখানকার এজেন্সিগুলো নানা ভুয়া তথ্য দিয়ে তাদের ফুসলিয়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে৷ কোন যোগ্যতায় যাওয়া যাবে তা তারা জানেও না, বলেও না৷’’
এ কারণেই এখন অনেক দেশ জানাচ্ছে, নিয়ম মেনে আবেদন করলে তাদের দেশে বৈধ অভিবাসনের সুযোগ আছে৷
এখানে বাংলাদেশের অভিবাসন মন্ত্রণালয়েরও অনেক দায় আছে বলে মনে করেন আব্দুল হালিম৷ তিনি বলেন, ‘‘কোন দেশে কোন ধরনের লোকের অভিবাসনের সুযোগ আছে, কী যোগ্যতা প্রয়োজন তা প্রচার করা দরকার৷ মানুষ যেন জানতে চাইলে সহজেই তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন তার ব্যবস্থা করা দরকার৷’’
২০২০ সালের জুনের ছবিঘরটি দেখুন..