ইউরোপে নিরাপত্তাবোধের অভাব
১৬ মে ২০১৬২০০৪ সালের মার্চে মাদ্রিদে ট্রেনে বোমাবাজি; ২০০৫ সালের জুলাইতে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে বোমাবাজি; ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শার্লি এব্দো হত্যাকাণ্ড; সে বছরের নভেম্বরে আবার প্যারিসে আক্রমণ; ২০১৬ সালের মার্চে ব্রাসেলসে গুলিবাজি৷ এ সব ঘটনা ইউরোপীয় মানসে গভীর দাগ কেটে গেছে৷ সে হিসেবে ইউরোপীয় মানস আজ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্কার্ড' অর্থাৎ দাগী৷
আইএস-এর মতো সন্ত্রাসী সংগঠন যখন তথাকথিত ‘সফ্ট টার্গেট' বেছে নেয়, তখন তাদের রোখা সহজ নয়, সম্ভবও নয়, বিশেষ করে ইউরোপের মতো মহাদেশে৷ এখানকার স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, পরিবহণ ব্যবস্থা, মুক্ত সীমান্ত, টেলিযোগাযোগ, সব কিছুই টেররিস্টদের ‘স্লিপিং সেল'-গুলির পক্ষেও অত্যন্ত সুবিধাজনক – যদিও তাদের উদ্দেশ্য হলো, যত বেশি সম্ভব নিরপরাধ ব্যক্তির প্রাণ নেওয়া৷
আজব শোনালেও, ফুটবলের ভাষায় বলতে গেলে, একদিকে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী, অন্যদিকে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের মধ্যে এই ‘ফুটবল খেলায়' পুলিশ খেলছে ফুটবলের নিয়মকানুন অনুযায়ী; সন্ত্রাসীরা কিন্তু মাঠেও থাকতে পারে, আবার গ্যালারিতে দর্শকদের আসনেও থাকতে পারে; আরো বড় কথা, তারা সাইডলাইনের যে কোনো জায়গায় বল পাঠাতে পারলেই সেটা গোল বলে গণ্য হবে৷ এমনকি ভুল মাঠ বা ভুল স্টেডিয়াম হলেও আপত্তি নেই৷
ইউরোপের মানুষের আজ এটা জানা যে, তারা কোথাও নিরাপদ নয় – অন্তত পুরোপুরি একশ' ভাগ নিরাপদ নয়; মিশরে পিরামিড দেখতে গেলেও নয়; টিউনিশিয়ায় ছুটি কাটাতে গেলেও নয়; আবার ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের বড় বড় শহরগুলিতেও নয়৷ কেননা সন্ত্রাসীরা সর্বত্র থাকতে পারে, সর্বত্র হানা দিতে পারে৷ তাহলে পুলিশ বা কর্তৃপক্ষের কর্তব্য?
প্রথমত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলাটা আরো ভালোভাবে খেলা, বিশেষ করে চুরি হওয়া এবং চোর পালানোর আগে৷ ঠান্ডা লড়াইয়ের আমলের ‘স্পাই ভার্সাস স্পাই'-এর মতো আধুনিক পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনীকে অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে এই অদৃশ্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে৷ এ যুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে, যখন কেউ টের পেল না, অথচ একটা সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ড ব্যাহত হল, অপরাধীরা ধরা পড়ল৷
এ সংগ্রামের দ্বিতীয় অংশটা বস্তুত পুলিশের হাতে নেই, কেননা তার পটভূমি যেমন একদিকে সংশ্লিষ্ট দেশটির সমাজ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট৷ ইউরোপের যে দেশগুলিতে সন্ত্রাসের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাদের সব ক'টিতেই একটি বড় আকারের অভিবাসী সম্প্রদায় আছে, যাদের একটি বড় অংশ আবার মুসলিম৷ এক্ষেত্রে ‘ইন্টেগ্রেশন' বা সমাজে অন্তর্ভুক্তিকে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের পন্থা ও অঙ্গ হিসেবে গণ্য করতে গেলে, পশ্চিমি, ইউরোপীয় সভ্যতাকে মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে আরো অনেক বেশি নিবিড়ভাবে, গভীরভাবে লিপ্ত হতে হবে, সংশ্লিষ্ট হতে হবে৷ ইউরোপের জনসংখ্যাগত বিকাশের জন্য এই অভিবাসীদের প্রয়োজন, তা তারা যেভাবে এবং যে সংখ্যাতেই আসুক না কেন৷ তাদের আসা পুরোপুরি বন্ধ করার চেষ্টা করলে, অভিবাসন আইনি ছেড়ে আরো বেআইনি পথ ধরবে; যারা আসবে, তাদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা আরো কঠিন হবে; বাড়বে অসন্তোষ, অতৃপ্তি ও সেই সঙ্গে ইসলামিক স্টেট প্রমুখ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির জন্য সোৎসাহী রংরুটদের সংখ্যা৷
অপরদিকে আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট বলতে বোঝায় ইরাক, সিরিয়া, অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকা, গোটা উত্তর আফ্রিকা জুড়ে যা কিছু ঘটছে বা ঘটছে না৷ এবং সে সব কিছুতে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা বা দায়িত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই৷ কাজেই হাত গুটিয়ে বসে না থেকে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাস্তবিক সংগ্রামে নামতে হবে৷ ইউরোপের মানুষ ভবিষ্যতে নিরাপদ বোধ করবেন কিনা, সেটা সন্ত্রাসীরা যতটা জানে, ততটাই সম্ভবত জানেন ইউরোপের মানুষরা নিজে৷ জানা এক ব্যাপার, আর সচেতন হয়ে ওঠাটা আরেক ব্যাপার৷ এবার বোধহয় সচেতনতার সময় এসেছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷