আয়কর আইনের উপরে ধনী, নীচে গরিব
৫ জুন ২০২৩কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে এতে আয়কর দেয়া লোকের সংখ্যা বাড়বে। আর যে ৪২টি সেবা নিতে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেই সেবা যারা নেন তাদের বছরে দুই হাজার টাকা কর দেয়ার সক্ষমতা আছে।
এবার ব্যক্তি আয়ের করমুক্ত সীমা তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। উল্টো দিকে ধনী করদাতাদের সারচার্জ মুক্ত আয়ের সীমা তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন এখানে স্পষ্ট যে যারা ধনী তাদের সুবিধা দেয়া হয়েছে।
প্রায় ১৭ কোটি জনংখ্যার এই দেশে সরকারি হিসেবে বর্তমানে টিআইএনধারী করদাতার সংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ। কিন্তু আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ৩২ লাখ। সেই হিসাবে টিআইএনধারী মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ। আর রিটার্ন দাখিল করে মোট জনসংখ্যার শতকরা দুই ভাগ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের( সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "২০১৮ সালে আমরা একটা জরিপে দেখেছি বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এরকম জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ কর আওতার বাইরে আছে। এরা যে লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিটের মধ্যে তা নয়। এরা সারাদেশেই ছড়িয়ে আছেন। কিন্তু এদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।”
তার কথা,"আমরা বলছি যারা ট্যাক্স দেয়ার যোগ্য তাদের করের আওতায় আনতে হবে। যারা ট্যাক্স ফাঁকি দেন তাদের কাছ থেকে ন্যায্য কর আদায় করতে হবে। কিন্তু সরকার করমুক্ত আয় সীমা তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা করার পর আবার করযোগ্য আয় না থাকলেও দুই হাজার টাকা করের প্রস্তাব ওই নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অনৈতিক। এনবিআরকে দক্ষতার সঙ্গে করযোগ্যদের খুঁজে বের করতে হবে। একদিকে গরিব মানুষের জন্য এটা করা হচ্ছে, অন্যদিকে যারা ধনী এবং সম্পদশালী যারা তাদের সারচার্জমুক্ত আয়সীমা তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে। এটা কি তাহলে গরিব মানুষের বিপরীতে ধনীদের সুবিধা দেয়া হলো? ন্যায্যতার বিচারে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।”
বাংলাদেশে এনবিআরের দুর্নীতি এবং অদক্ষতা রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পথে প্রধান বাধা। এখনে মোট রাজস্বের ৩৫ ভাগ আসে আয়কর বা ডাইরেক্ট ট্যাক্স থেকে। আর বাকি ৬৫ ভাগ আসে ভ্যাটসহ অন্যান্য ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স থেকে। এটা একটি বড় দুর্বলতা। আয়কর থেকে সবচেয়ে বেশি আদায় হওয়া উচিত বলে মনে করেন খন্দকার গেলাম মোয়াজ্জেম।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন বলেন, "বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে আয়কর দাতার সংখ্যা খুবই কম। এই অনুপাতে আমরা এশিয়ায় সবার পিছনে আছি। দেশে প্রচুর লোক আছেন যারা কর দেয়ার যোগ্য হলেও দেন না। শুধু শহরে নয় ,এখন গ্রামেও দেখবেন সুন্দর সুন্দর ভবন ও বাড়িঘর। তারা কি আয়কর দেন? তাই আমি মনে করি এই যে দুই হাজার টাকার বিধান এটা আয়কর দাতা বাড়াতে কাজে লাগাতে হবে। মানুষ টিআইএন খুলবেন। কিন্তু তাকে সম্মানিত করতে হবে। দুই হাজার টাকা দিলে ধরুন ৫০০ টাকা তাকে রেয়াত দিতে হবে। তাকে বুঝাতে হবে আয়কর দেয়া গর্বের। তাই দুই হজার টাকা নিয়ে আমি সমালোচনার কিছু দেখি না। আসল কথা হলো যোগ্য আয়কর দাতাদের ট্যাক্স নেটের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।”
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এবার ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে এনবিআরকে। আইএমএফ জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের অনুপাত ৭.৮ থেকে বাড়িয়ে ৯.৫ শতাংশে উন্নীত করার শর্ত দিয়েছে।
কিন্তু সেটা কি এই দুই হাজার টাকা দিয়ে হবে? প্রতিবছরই এএনবিআর রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসেবে চলতি অর্থবছরের (২০২২-১৩) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হতে পারে ৫৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
আর এই ঘাটতির পিছনে আছে কর ফাঁকি, কর না দেয়া। এর সঙ্গে এনবিআরের অদক্ষতা আর দুর্নীতির বিষয়ও যুক্ত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি) এক গবেষণায় দেখেছে ২০০৯-১০ এক অর্থবছরেই ২১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "একটি শ্রেণি ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেয়। আবার এনবিআর অদক্ষতার কারণেও কর ফাঁকি ধরতে পারে না। তাই কর্পোরেট লেনদেন যদি কেন্দ্রীয় একটি ডিজিটাল সিস্টেমের অধীনে আনা যেত, অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতির মধ্যে আনা যেত তাহলে এই কর ফাঁকি রোধ করা যেত।”
গোলাম হোসেন বলেন, "ব্যাংক ঋণ নেয়ার সময় আয় বেশি দেখায়। কর দেয়ার সময় আয় কম দেখায়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় বড় বেতনধারী বেতনের একটি অংশ ক্যাশে নিয়ে আয়কর ফাঁকি দেয়। আর প্রতিষ্ঠানও খরচ এবং আয় কম দেখায়।”
সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, "আয়কর হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে । যার বেশি আয় তিনি বেশি কর দেবেন। যার আয় কম তিনি কম কর দেবেন। যার করযোগ্য আয় নেই তিনি কেন কর দেবেন? যে ৪২ ধরনের সেবার কথা বলা হচ্ছে সেটা নিতে গেলে তো কর দিতেই হয়। কিন্তু দুই হাজার টাকার বিধানের মধ্য দিয়ে ওই সেবা নিতে আলাদাভাবে যোগ্য হতে হবে কেন? সাধারণ মানুষ তো এমনিতেই কর দেয়। খাবার কিনলে ভ্যাট দেয়। তেল কিনলে দেয়। সাবান কিনলে দেয়।”
তার কথা, "বাংলাদেশের শীর্ষের ১০ ভাগ লোকের হাতে জাতীয় আয়ের ৩৫ ভাগ। তারা যদি কমপক্ষে ১০ শতাংশ করও দেয় তাহলে তো জিডিপির অনুপাতে ৩.৫ শতাংশ কর সেখান থেকে আসার কথা। সেটা তো আসছে না। তার মানে যারা অনেক হাই ইনকামের তাদের আমরা ট্যাক্স নেটের আওতায় আনতে পারি নাই। আর সেই কারণে আমি নির্বিচারে সবার কাছ থেকে দুই হাজার করে কর নেব?”
তিনি বলেন," তিন লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি বছরে আয় হলেই এখন আয়কর দিতে হবে। মাসে আয় ৩০ হাজার টাকা। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে এই টাকা দিয়ে মাসে পরিবার নিয়ে চলাইতো অনেক কঠিন।”