‘আর্থিক লেনদেনে সঠিক পরিচর্যার ঘাটতি আছে'
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটিই বলেছেন তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির৷ ‘ফাইবার অ্যাট হোম' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার তিনি৷
ডয়চে ভেলে: মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশে চার কোটি অ্যাকাউন্ট আছে৷ সচল আছে এক কোটি ৫৮ লাখ৷ মোবাইল ফোন গ্রাহক ১২ কোটি৷ এই মার্কেট আর কত বড় হওয়ার সুযোগ আছে বলে আপনি মনে করেন?
সুমন আহমেদ সাবির: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মার্কেট আসলে আরো বড় হওয়ার সুযোগ আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ এটা যে সব মানুষ ব্যবহার করছে, তা নয়৷ এটা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং এটির ব্যবহার সহজ হওয়ায় অনেক মানুষ এটা ব্যবহার করছেন৷ তবে এটা ব্যবহারে ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে৷ যাঁরা সার্ভিস দিচ্ছেন, তাঁদের আরো ট্র্যান্সপারেন্ট ও ভালো সার্ভিস দিতে হবে৷ এর খরচটা যদি আর একটু কমানো যায় তাহলে এটি আরো জনপ্রিয়তা পাবে৷ ফোনের গ্রাহক এখন আর খুব একটা বাড়ছে না৷ এটি আসলে বাড়বে আমাদের অর্থনীতি বাড়ার উপরে৷ শহরে প্রত্যেকের হাতে একটি ফোন থাকলেও গ্রামে দেখা যায় একটি পরিবারে একটি বা দু'টি ফোন আছে৷ দেশের অর্থনীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাবে এই সংখ্যাটা আরো বাড়বে৷ তবে যে গতিতে বাড়ছিল সেভাবে আর বাড়বে না৷ তবে ইন্টারনেট মার্কেট আরো অনেক বাড়ার সুযোগ আছে৷
২০১৬ সালে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকা, যা আমাদের বাজেটের সমান৷ এখন পর্যন্ত যে লেনদেন বা যে অ্যাকাউন্ট আছে সেটা কি যথেষ্ট ?
যথেষ্ট কিনা সে প্রশ্ন আপেক্ষিক৷ মানুষ যখন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তখনই সে সেটা ব্যবহার করে৷ আরেকটি হলো প্রচার৷ আমার মনে হয় প্রচারের জায়গা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে৷ এখন মানুষ এ সম্পর্কে জানে৷ যার প্রয়োজন পড়ছে সে-ই ব্যবহার করছে৷ এখন যদি এটাকে আরো বহুমাত্রিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে এটার ব্যবহার আরো বাড়বে৷
আমাদের মোবাইল ব্যাংকিংটা ‘বিকাশ' এবং ডাচ বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট' এই দু' প্রতিষ্ঠানের মাধ্যেই আটকে আছে৷ অন্যরা এর মধ্যে আসার সুযোগ পাচ্ছে না৷ আমরা জানি , মোবাইল ফোন অপারেটররা এর মধ্যে আসতে চায়, তাদের আসার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না৷ এক্ষেত্রে সরকারের পলিসির কোনো পরিবর্তন দরকার ?
একটা জিনিস হলো, সব ব্যবসা সবাইকে করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই৷ মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেই তো এটা হচ্ছে৷ এখন নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে অন্য কেউ এই ব্যবসায় আসুক৷ সেই সুযোগ কিন্তু আছে৷ দু'টি কোম্পানি সফল হয়েছে৷ আরো অনেকেই চেষ্টা করে হয়ত সফল হতে পারেনি৷ এখন অনেকেই চেষ্টা করছেন, ভিন্নভাবে, ভিন্ন আঙ্গিকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাটাকে নিয়ে আসার৷ আমার মনে হয়, কেউ যদি ভালো সেবা নিয়ে আসে তাহলে এই মার্কেটে জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ আছে৷
আর্থিক ডিজিটালাইজেশনের পথে কত দূর এগোলাম আমরা?
আমরা এগিয়েছি, এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ গত ৫ বছরে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি৷ এখানে আরো অনেক অনেক দূর যাওয়ার সুযোগ রয়েছে৷ এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আমরা শুধু টাকার লেনদেন করতে পারছি৷ কিন্তু ই-কমার্স বা অন্যান্য আর্থিক লেনদেন করতে পারছি না৷ এখান থেকে আমরা অনেক দূরে রয়েছি৷ আমাদের অনেক দূর যেতে হবে৷
লাখ লাখ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে৷ নিরাপত্তার বিষয়ে সরকার কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে?
আসলে সরকারের দিক দিয়ে গত এক দুই বছরে আর্থিক খাতে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাতে সবাই বেশ সতর্ক৷ এই জায়গাতে আমাদের সঠিক পরিচর্যার অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে৷ সেখান থেকেই এই জাতীয় ঘটনা ঘটার সুযোগ তৈরি হচ্ছে৷ এই জায়গায় আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে৷ এখন কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা তৎপরতা দেখাচ্ছি, কিছুদিন পর সেটা ভুলে যাচ্ছি৷ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে, সুষ্ঠু ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে এটা করতে হবে৷ এর মধ্যে জেনেছি, বাংলাদেশ ব্যাংক একটা পরিকল্পনা নিচ্ছে যে, প্রতি বছর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইটি অডিট করতে হবে৷ এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন৷ সরকারের দিক থেকে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে সব ব্যাংক এগুলো মেনটেন করছে কিনা সেটা মনিটরিং করতে হবে৷ তা না হলে এই ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে, এবং আমরা আরো বেশি বিপদের সম্মুখীন হবো৷
সরকারের সমস্ত লেনদেন চলে গেছে ডিজিটাল বা অনলাইন পদ্ধতিতে৷ প্রাইভেট সেক্টরের লেনদেন কেন ডিজিটাইজ হচ্ছে না? দুর্বলতা কী?
প্রাইভেট সেক্টরের একই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেনগুলো কিন্তু অনলাইনের মাধ্যমেই হচ্ছে৷ সবার বেতন নিজস্ব অ্যাকাউন্টে চলে যায়৷ এখন কিন্তু কেউ হাতে ক্যাশ টাকায় বেতন দেয় না৷ তবে একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটা প্রতিষ্ঠানের লেনদেন সেভাবে অনলাইনে হয়নি৷ এক্ষেত্রে একটা অভ্যস্ততার বিষয় আছে বা এই সেবাগুলো নিয়ে আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে এগিয়ে আসেনি৷ এখানে আরেকটু এগুনোর সুযোগ আছে৷
আর্থিক লেনদেনে আমরা কিছু সমস্যা হতে দেখছি৷ বিকাশ থেকে রকেটে টাকা পাঠানো যায় না৷ আবার রকেট থেকে বিকাশে পাঠানো যায় না৷ এক্ষেত্রে কোনো পরামর্শ আছে ?
এখানে দু'টো জিনিস, একটা হলো, অনেক জায়গায় তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এই দায়িত্ব নেয়৷ তারা এই ধরনের ইন্টার অপারেটিভিলিটির সুযোগ করে দেয়৷ আমার ধারণা, এই ধরনের উদ্যোগ নিয়ে কেউ কেউ কাজ করছেন৷ ভালো হয় যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে কোনো স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা যায়৷ আমরা এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে টাকা পাঠাতে পারি৷ সেখানে মোবাইল ব্যাংকিংয়েও এটা সম্ভব৷ প্রযুক্তিগতভাবে খুব বেশি যে বাধা আছে তা নয়, সেভাবে নিয়ন্ত্রিত কোনো ব্যবস্থা যদি চালু করা যায়, তাহলে সেটাও হবে৷ এখন দু'টি প্রতিষ্ঠান বলে হয়ত হচ্ছে না, আরো দু-একটি প্রতিষ্ঠান যদি ভালোভাবে মার্কেট পায়, তাহলে দেখবেন এটা সমাধানের ব্যবস্থা হবে৷
সরকার বলছে, আর্থিক ডিজিটাইজেশনের কারণে রেমিটেন্স কমে যাচ্ছে৷ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ,বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হচ্ছে৷ এ কারণে কি এই ইন্ড্রাস্ট্রিতে কোনো প্রভাব পড়তে পারে?
আমার মনে হয়, এটা একটু একতরফা বক্তব্য হলো৷ হুন্ডির মাধ্যমে মানুষ তখনই টাকা পাঠায়, যখন দেশে মুদ্রার মানের একটা তারতম্য লক্ষ্য করা যায়৷ এখন দেখবেন, ব্যাংকে ডলারের যে দাম, বাইরে তার চেয়ে দাম অনেক বেশি৷ মানুষ যখন দেখে বাইরের মাধ্যমে টাকা পাঠালে সে আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হচ্ছে, তখন সে ওই মুখো হয়ে যায়৷ এখানে যদি একটা সাম্যতা রক্ষা করা যায়, তাহলে দেখবেন যে রেমিটেন্স কমবে না৷ কারণ, মানুষ নিরাপদ পদ্ধতিতে আর্থিক লেনদেন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে৷
ডিজিটাল হওয়ার কারণে আমাদের কী কী পরিবর্তন এসেছে বলে আপনি মনে করেন?
এটা তো একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম৷ তবে সার্বিকভাবে যদি বলি, আমাদের জীবনযাত্রায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে৷ যদি শিশুদের কথা বলি, ইন্টারনেটের ফলে শিশুদের ভিডিও, গেইমিং অনেক বেড়ে গেছে৷ এটা একদিক দিয়ে ভালো যে তারা বাসায় সময় কাটাচ্ছে৷ আবার এর ফলে তার লেখাপড়া বা মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ এই জায়গাগুলোতে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে৷ আমাদের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক দিকগুলো যেন আমরা নেই এবং নেতিবাচক দিকগুলো থেকে যেন আমরা দূরে থাকি৷ যাতায়াতের ক্ষেত্রে বলি, উবার বা এই ধরনের সেবা বাংলাদেশে এসেছে৷ এতে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন হয়েছে৷ ই-কমার্সে অর্ডার দেয়া অনেক বেড়ে গেছে৷ টেলিফোনে অর্ডারের পরিমানও অনেক বেড়ে গেছে৷ সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে৷ এই জায়গায় সচেতনতার একটা বড় প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়৷
ডিজিটাইজেশনের ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ ...
ডিজিটাইজেশনের ক্ষেত্রে সরকার যে সেবার উদ্যোগ নিয়েছে, কিছু কিছু জায়গায় খুবই ভালো৷ আবার কিছু জায়গায় দায়সারা গোছের করা হয়েছে৷ এটা হতে পারে যারা করেছেন, তাদের হয়ত সঠিকভাবে করার যে দক্ষতা, সেটা ছিল না৷ সেই জায়গাতে নতুন করে ভাবা যে করলে মানুষের আরো কাছে পৌঁছানো যায়৷ এটা করা গেলে সরকারও মানুষের অনেক কাছাকাছি যেতে পারছে, মানুষের মতামতগুলো তারা জানাতে পারছে এবং এটাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে আমাদের গভর্ননেন্সের জায়গায় একটা বড় উন্নতির সম্ভাবনা আছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷