‘আমি খুব গর্ব অনুভব করি’
২৯ জুন ২০১১একাত্তরের মার্চ মাসে খায়রুল বাশার ছিলেন খুলনায়৷ তখন তিনি চাকরি করতেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে৷ ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান'এর ভাষণ বাশারকে নাড়া দেয়৷ তিনি বুঝতে পারেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ আসন্ন৷ তাই তখনই সাতক্ষীরায় ফিরে যান বাশার৷ সমমনা তরুণদের নিয়ে শুরু করেন গেরিলা প্রশিক্ষণ৷ তখন তাদের কাছে অস্ত্র ছিল না, ডামি রাইফেল দিয়েই চলত প্রশিক্ষণ৷
সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা
এরপর এলো ২৫ মার্চ৷ যুদ্ধ শুরু৷ বাশাররা তখন চলে গেলেন গ্রামে৷ মুক্তির লড়াইয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে৷ ডয়চে ভেলেকে খায়রুল বাশার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা ভেবেছিলাম যে, দীর্ঘকালীন মুক্তিযুদ্ধ হয়ত সামনে চলে আসবে৷ তার জন্য আমার বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গ্রামে চলে যাই৷ উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা৷''
সম্মুখ যুদ্ধ
এভাবে একসময় সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন বাশার৷ জুন মাসের কথা৷ তারা অবস্থান করছিলেন ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের ভোমরা অঞ্চলে৷ পাকিস্তানি সেনারা এক রাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উপর৷ সম্মুখ যুদ্ধ চলে দীর্ঘ সময়৷ তিনি বলেন, ‘‘সেটা বড় যুদ্ধ ছিল৷ প্রায় সতের থেকে আঠার ঘণ্টা যুদ্ধটা ছিল৷ আমাদের পক্ষ থেকে দু'জন মারা গিয়েছিল৷ তবে অনেক পাকিস্তানি সেই যুদ্ধে প্রান হারায়৷''
ছয় সহযোদ্ধাকে হারানো
সেই যুদ্ধে শেষ অবধি টিকতে পারেননি বাশাররা৷ পাকিস্তানি গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের কারণে একসময় পিছু হটতে হয় তাদের৷ মর্টারের গোলা আর বৃষ্টির মধ্যে পেছনে হটে আসার সেই চেষ্টা এখনো মনে আছে তাঁর৷ তবে একাত্তরের যুদ্ধে বাশারের কাছে সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিল, কয়েক সহযোদ্ধাকে হারানোর ঘটনা৷ জুলাই মাসে টাকি হাসনাবাদ এলাকার যুদ্ধে ছয় সহযোদ্ধাকে হারান তিনি৷ বাশার বলেন, ‘‘আমাদের একটা দলকে পাকিস্তানিরা ঘিরে ফেলেছিল৷ রাতের বলে ওরা সাংঘাতিকভাবে গোলাগুলি করে আমাদের ছয় সহযোদ্ধাকে হত্যা করে৷''
নাটকের দল
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বাশার নাটকের দল তৈরি করেন৷ একাত্তরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সেনা ক্যাম্প এবং শরণার্থী শিবিরে নাটক দেখায় তাঁর দল৷ এজন্য সেই কয়েকমাস তিনি ঘাঁটি গেড়েছিলেন বশিরহাট এলাকায়৷ তাঁর কথায়, ‘‘শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে, মুক্তাঞ্চলের মানুষের মধ্যে আমরা নাটক করতাম৷''
বিজয়ী বাশার
এভাবে চলে আসে ডিসেম্বর, বিজয়ের মাস৷ সেই মাসের ৩ তারিখ নাটক ছেড়ে আবারো সেনা ক্যাম্পে ফেরেন বাশার৷ তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধ করতে করতেই আমরা সাতক্ষীরা ঢুকি৷ ডিসেম্বরের সাত তারিখ৷''
বিজয়ের পর সাতক্ষীরার সাংস্কৃতিক অঙ্গন পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হন বাশার৷ ৭২ সালের ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসে খুলনায় মঞ্চ নাটক পরিচালনা করেন তিনি, নাম ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ'৷ সেটি সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মঞ্চ নাটক৷ এরপর বাশার ফিরে যান নিজের কর্মক্ষেত্রে৷
গর্ব, হতাশা
এই বিজয়ী সেনা জানান, বাঙালি জাতির জন্য একাত্তরের বিজয় সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি৷ কিন্তু সেই বিজয়ের পর বাংলাদেশে অনেক কিছু ঘটে গেছে, যা হতাশ করেছে তাঁকে৷ তবে একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নিতে পেরে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হতে পেরে গর্বিত খায়রুল বাশার নুরুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি খুব গর্ব অনুভব করি৷ আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, একটি জাতির মুক্তির যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম৷''
গ্রন্থনা: আরাফাতুল ইসলাম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক