সামাজিক কোরবানি
৬ অক্টোবর ২০১৪১৯৯০ সালের কথা৷ আমি সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি৷ থাকতাম জহিরুল হক হলে৷ অর্থনীতি বিভাগে পড়ার সময় আমাদের কয়েকজন সহপাঠী ছিলেন পুরনো ঢাকার৷ ঠিক মনে নেই, একবার কোরবানির ঈদে কী কারণে যেন গ্রামের বাড়ি যাইনি, হলেই ছিলাম৷ আর হলে থাকব এই খবর পেয়ে আমাদের সহপাঠী পুরনো ঢাকার আবিদ আগেই দাওয়াত দিয়ে রেখেছিল৷ আমি সকালেই বের হই৷ ঈদের নামাজ পড়ি পুরনো ঢাকায় আবিদের সঙ্গেই৷ তারপর কোরবানি দেখার পালা৷ আর সেই কোরবানি আমার চোখ খুলে দেয়৷ আমাকে কোরবানি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়৷
সামাজিক কোরবানি
পুরনো ঢাকার রেওয়াজ অনুযায়ী আবিদদের পাড়ার যারা কোরবানির পশু কিনেছেন তারা সব এক জায়গায় নিয়ে এলেন, গরু-ছাগল সব৷ এরপর একসঙ্গে কোরবানি দেয়া হলো৷ কোরবানির মাংস তৈরির পর পাড়ার লোকের সবার তালিকা ধরে মাংস ভাগ করা হল৷ যারা কোরবানির পশু কিনতে পারেননি তাদের জন্যও৷ সবাইকে মাংস দেয়া হল৷ কেউ বাদ পড়লেন না৷ আমি বিস্মিত হলাম, অভিভূত হলাম – এই সাম্য দেখে৷ পরে আবিদ আমাকে জানায় একে বলা হয় সামাজে কোরবানি৷
পরে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেয়ার পর এই সামাজিক কোরবানির খবর সংগ্রহ করতেও পুরনো ঢাকায় গিয়েছি৷ খবর তৈরি করেছি৷ প্রচার করেছি৷ তবে সামাজিক কোরবানির এই রেওয়াজ দিন দিন কমে আসছে৷ যা আমাকে কষ্ট দেয়৷
শৈশবে আমাদের বরিশালের গ্রামের বাড়িতেও দেখেছি একই ধরনের কোরবানি৷ এক বাড়ির যত গেরস্থ তারা সবাই একসঙ্গে কোরবানি দিতেন৷ তারপর যারা দিতে পারতেন না তাদের ভাগ করে মাংস দেয়া হতো৷ প্রতিবেশীরাও বাদ যেতেন না৷ আর খাওয়ার সময় বাড়ির সবাই চাদর পেতে একসঙ্গে বসতেন৷ সবার রান্না করা মাংস এক জায়গায় এনে তারপর সবাই মিলে খেতেন৷ সেই রেওয়াজও এখন আর নেই৷
কোরবানির ইতিহাস ত্যাগ ও মহিমার৷ ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন৷ আল্লাহ তাঁর কোরবানি কবুল করে নেন৷ ইসমাইলের পরিবর্তে কোরবানি হয়ে যায় পশু৷ আর এই পশু কোরবানি একটি উপলক্ষ্য৷ এর মাধ্যমে মনের পশুকে কোরবানি দিতেই বলা হয়েছে৷ মনের সব পাপ, অসততা, জরা কোরবানিই হল আসল কোরবানি৷
নিয়ম মেনে কি কোরবানি হচ্ছে?
ঢাকার পশুর হাটে গরু কেনার প্রতিযোগিতা৷ বাহারি গরু কিনতে বিত্তবানরা অকাতরে টাকা ঢালছেন৷ আর সেই গরু হাট থেকে বাসায় নিয়ে এসে আয়োজন করা হয় প্রদর্শনীর৷ কে কত বড় গরু কিনেছেন৷ কার গরুর কত দাম তা নিয়েই চলে আলোচনা৷
আলোর নীচে যেমন অন্ধকার, তেমনি স্বাস্থ্যবান এই পশুর দিকে তাকিয়ে থাকে লিকলিকে মানব সন্তান৷ তার চেয়ে দেখাই সার৷ মাংস তার কপালে জুটবে কী না তা নিশ্চিত নয়৷ কারণ পশু কোরবানির যে নিয়ম তা অনেকেই ভুলতে বসেছেন৷ তিনভাগ মাংসের দু'ভাগ গরীব আর আত্মীয় স্বজনের পাওয়ার কথা থাকলেও তা তেমন আর হয় না৷ তাই যদি হত তাহলে কোরবানির আগে ঢাকায় বিশাল আকারের ডিপ ফ্রিজের বিক্রি এত বেড়ে যেতো না৷ গরিবের হক, প্রতিবেশীর হক হয়তো জমা হবে ডিপফ্রিজে৷
অর্থনীতির ছাত্র আমি৷ সাংবাদিক আমি৷ আমি আমার একাধিক প্রতিবেদনে দেখিয়েছি ঈদ উত্সবে সামাজিক বৈষম্য দেখা যায় বেশি৷ প্রকট আকারে ধরা পড়ে৷ ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আযহা যেটাই হোক না কেন৷ কারণ বাংলাদেশে মুসলমানদের এই দু'টি মহান ধর্মীয় উত্সবকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির মানুষ তাদের সম্পদ দেখানোর মওকা পেয়েছেন৷ তারা মহান আদর্শের ধারে কাছে নেই৷ ঈদের জামায়াতে এককাতারে নামাজ পরে, ঈদের সুমহান আদর্শের বয়ান শুনে ঈদগাঁ থেকে বের হয়েই তা ভুলে যান৷
জাকাত নাকি বদান্যতা
জাকাত দেয়ার নামে নিরন্ন মানুষকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়া করিয়ে একটি শাড়ি বা লুঙ্গি তুলে দেন৷ আর এই বদান্যতার উলঙ্গ প্রকাশের শিকার হয়ে প্রতিবছরই ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে মারা যান কেউ না কেউ৷ গত ঈদ-উল-ফিতরেও বরিশালে মারা গেছেন তিনজন৷ আর কোরবানির ঈদে একদল আছেন লাইনে লোক দাঁড়া করিয়ে মাংস বিলি করেন৷ লম্বা লাইন হয়৷ ক্ষুধার্ত মানুষের সানকিতে দেয়া হয় এক কী দুই টুকরা মাংস৷ কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি বাংলাদেশে ঈদ-উল-আযহায় যত পশু কোরবানি হয় তা যদি ইসলামের রীতি অনুযায়ী বিলি বণ্টন করা হয় তাহলে ষোল কোটি মানুষ সবাই অন্তত একবেলা তৃপ্তির সঙ্গে খেতে পারেন৷ অথবা পুরনো ঢাকার মত যদি সমাজে কোরবানি হয় তাহলে কাউকে লাইনে দাড়িয়ে মাংস নিতে হবে না৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয় না৷
আর কোরবানির মূল আদর্শের কথাতো বাদই দিলাম৷ আমরা যদি সেই ত্যাগের আদর্শে উজ্জীবিত হতে পারতাম তাহলে সমাজে হিংসা, হানাহানি থাকতো না৷ বেশি লাভের আশায় কৃত্রিমভাবে কোরবানির গরুকে ওষুধ খাইয়ে মোটা-তাজা করে প্রতারণা করতেন না ব্যবসায়ীরা৷ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে কাউকে জীবন দিতে হতো না৷ কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে হতো না বন্দুক যুদ্ধ৷ আর কালো টাকার প্রতিযোগিতায় সাম্যের উত্সব অসাম্যের প্রকাশ ঘটতো না৷
তবুও আশায় বুকবাধি প্রকৃত কোরবানির আদর্শে একদিন উজ্জীবিত হবেন আমার দেশের মুসলমানরা৷ সাম্য আর ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে ঈদের আদর্শে৷