আমার দেখা ‘অচেনা' কিছু সমুদ্র সৈকত
২ ডিসেম্বর ২০১৭টেকনাফের শামলাপুর, শিলখালি আর হাজামপাড়া – প্রায় গায়ে গা লাগানো এই তিনটি সমুদ্র সৈকত নতুন চালু হওয়া কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পাশ দিয়ে চলে গেছে৷ আগে এ সৈকত তিনটিতে মানুষের বিশেষ আনাগোনা ছিল না৷ অবশ্য আগে তেমন সুযোগ-সুবিধাও ছিল না৷ কিন্তু মেরিন ড্রাইভ চালু হবার পর, এই সৈকতগুলোতেও এখন পর্যটকের ঢল নামে, নিয়মিতই৷
২০০৯ সালে প্রথম গিয়েছিলাম শামলাপুর সৈকতে৷ টেকনাফের গেম রিজার্ভে বুনো হাতি দেখতে গিয়েছিলাম৷ টেকনাফের হোয়াইখং থেকে তৈঙ্গা পাহাড় অতিক্রম করে রাতের অন্ধকারে এসে তাঁবু গেড়েছিলাম শামলাপুর সৈকতের বেলাভূমিতে৷ হাতির ভয়ও ক্লান্তি তাড়াতে পারেনি৷ নির্জন সৈকতে সেই তাঁবুর মধ্যে মগ্ন হয়েছিলাম গভীর ঘুমে৷ সকালে ঘুম ভেঙেছিল একদল কৌতূহলী মানুষের হল্লায়৷
সেবারের দেখা শামলপুর সৈকত মনে ধরেছিল খুব৷ কক্সবাজার গেলেই নানান উৎরাই পেরিয়ে তাই চলে যেতাম জায়গাটিতে৷ এরপর একবার শামলাপুর বেড়াতে গিয়ে দেখা পাই শিলখালি আর হাজামপাড়া সৈকতের৷ একবার শিলখালি সৈকতেও তাঁবুবাসের সুযোগ হয়েছিল৷ ঘুম ভেঙে দেখেছিলাম তাঁবুর চারপাশটায় লাল কাঁকড়ারা কিলবিল করছে৷ হাজামপাড়া সৈকত দেখে তো প্রথমে ভ্রমই হয়েছিল, সেন্ট মার্টিনে এসে পড়েছি না তো!
কক্সবাজারে আরো তিনটি অপূর্ব সমুদ্র সৈকত দেখেছি৷ মানুষজন খুবই কম যান জায়গা দু'টিতে৷ এর একটি সোনাদিয়া দ্বীপ৷ যাতায়াত কষ্টসাধ্য বলেই পর্যটকরা তেমন ভেড়েন না ঐ দিকে৷ শীতের মৌসুমে ‘স্পিডবোট'-এ সোনাদিয়া যাওয়া যায়৷ তখনো মহেশখালী চ্যানেল আর সমুদ্রের মোহনায় বিস্তর ঢেউ থাকে৷ বর্ষা মৌসুমে তো মহেশখালী যাওয়াই বন্ধ হয়ে যায়৷ মনে আছে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম সেই দ্বীপে৷ খুবই নির্জন সৈকতে নানান পাখির বিচরণ দেখেছিলাম সেবার৷ এরপরও কয়েকবার গেছি দ্বীপটায়৷ মহেশখালীর ধলঘাটা সমুদ্র সৈকতের নাম হয়ত শুনেননি অনেকেই৷
কক্সবাজার জেলার আরেক দ্বীপ কুতুবদিয়া৷ দ্বীপটির পশ্চিমপ্রান্তজুড়ে পুরোটাই সমুদ্র সৈকত৷ বন্ধুর বাড়ি থাকার সুবাদে বহুবার যাওয়া হয়েছে জায়গাটিতে৷ এ সমুদ্র সৈকতেও পর্যটকদের খুব একটা দেখা পাইনি৷ সুন্দর দ্বীপ কুতুবদিয়া৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাও বিচিত্র৷ প্রাকৃতির নানা বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আজন্ম লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জীবনযাত্রা উপভোগ করা যায় ছোট্ট এই দ্বীপে৷ আগে অবশ্য হোটেল রেস্তোরাঁ ছিল না এখনে৷ তবে এখন সেসব হয়েছে৷ প্রাচীন বাতিঘর, বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শুঁটকি কেন্দ্র, সৈকতজুড়ে ঝাউবনসহ আরো অনেক কিছুই আছে এই দ্বীপে৷
নোয়াখালীর হাতিয়ায় অবস্থিত নিঝুম দ্বীপ৷ এক সময়ে প্রচুর হরিণ দেখা যেত এ দ্বীপের প্যারাবনে৷ আমিও ছোট্ট এ দ্বীপে গিয়েছিলাম হরিণ দেখতে৷ বনে বনে ঘোরার পর গিয়েছিলাম এখানকার সমুদ্র সৈকত দেখতেও৷ সত্যিই বিমোহিত হয়েছিলাম৷ নিঝুম দ্বীপের গোটা দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে বিস্তীর্ণ বেলভূমি৷ সেখানে লাল কাঁকড়া আর সামুদ্রিক পাখিদের নির্ভয় বিচরণ৷ নিঝুম দ্বীপের সৈকতে দেখা সূর্যাস্তের সেই মায়াময় রূপভোলা সম্ভব নয় কখনোই৷
পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে সোনারচর৷ গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে দশ কিলোমিটার দূরের পানপট্টি থেকে ছোট লঞ্চে চেপেছিলাম তাপসী দ্বীপের উদ্দেশ্যে৷ পথে আগুনমুখো মোহনার ভয়াবহতা টের পেয়েছিলাম৷ তাপসী দ্বীপে নেমে ঘণ্টাখানেক হেঁটে পৌঁছেছিলাম সোনারচরে৷ কিন্তু সৈকতে পা ফেলেই দীর্ঘ ভ্রমণের সব ক্লান্তি ভুলেছিলাম সেদিন৷ প্রায় দশ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতে মানুষের ছিটফোটা নেই৷ সদ্য জোয়ারে ধুয়ে যাওয়া বেলাভূমিতে একদল জেলের জাল তোলা দেখে কাছে গিয়েছিলাম৷ জানতে পেরেছিলাম এ সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত – দু'টোই দেখা যায়৷ তবে সময় স্বল্পতায় তার কিছুই দেখা হলো না৷ দিনে দিনেই যে ফিরতে হয়েছিল সেবার...৷
বরগুনার লালদিয়া সুমদ্র সৈকতও কম সুন্দর নয়৷ হরিণঘাটা জঙ্গলের শেষ প্রান্তে এই সমুদ্র সৈকত৷ বন ধরে হেঁটে গেলে সমুদ্রে পৌঁছাতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক৷ এ সমুদ্র সৈকতটি খুব দীর্ঘ নয়৷ কিন্তু সৌন্দর্যের যেন কোনো কমতি নেই!
বাংলাদেশের সুন্দরবন লাগোয়াও বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত আছে৷ নির্জনতা, বাঘের ভয়, সুন্দরী-গড়ান-কেওড়ার জড়াজড়ি মিলিয়ে অন্যরকম এক জায়গা৷ অতিপ্রাকৃত, অপার্থিব৷ পক্ষির চর থেকে ডিমের চর, কচিখালী থেকে জামতলা, টিয়ার চর থেকে দুবলার চর আর মান্দারবাড়িয়া থেকে পুটনি দ্বীপ৷ একেকটি সমুদ্র সৈকত যে একেকটি বিশ্ময়৷ সুন্দরবনে দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় কাজ করার সুবাধে সবগুলো সৈকতেই যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তাও আবার বারবার৷ কোনো কোনো সৈকতে দিনভর বেড়িয়েছি, অথচ বেশিরভাগ সময়ই কোনো মানুষের দেখা পাইনি৷
আমার দেখা বাংলাদেশের এ সব ‘অচেনা' সমুদ্র সৈকতগুলিতে খুবই কম সংখ্যক পর্যটক যান৷ এই না যাওয়ার প্রধান কারণ মনে হয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব৷ এ সব সৈকতগুলোতে যাতায়াত ব্যবস্থা যেমন খুবই খারাপ, তেমনি অভাব আছে হোটেল-মোটেলেরও৷ তাই দেশের দক্ষিণ দিকজুড়ে প্রকৃতির অমূল্য দান এ সব সমুদ্র সৈকতে পর্যটক টানতে হলে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে৷ কারণ উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থাই পর্যটন উন্নয়নের পূর্বশর্ত৷ পাশাপাশি হোটেল-মোটেল নির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি উদ্যেক্তাদেরও৷
বন্ধুরা, ব্লগটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷