আমার ভুলগুলো ওদের ভেতর দেখতে চাইব না
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০মেহরাব হোসেন অপি বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক চিরবিস্ময়৷ প্রতিভার কারণে; প্রতিভার অপচয়ের কারণেও৷ তাতে নিজের দায় ঠিকই দেখেন৷ এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ দল বিশ্বকাপ জেতার পর উত্তরসূরীদের প্রতি তাই মেহরাবের খ্যাতির বিড়ম্বনা নিয়ে সতর্কবার্তা৷ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নোমান মোহাম্মদ৷
ডয়চে ভেলে : কম বয়সে সাফল্য আপনিও পেয়েছেন৷ মাত্র ২০ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক; ২১ বছর বয়সে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান৷ আর এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ দল তো বিশ্বকাপই জিতল৷ এত কম বয়সের সাফল্যে কেমন লাগে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলেন?
মেহরার হোসেন অপি : আমি যখন খুব অল্প বয়সে সেঞ্চুরিটি পেলাম, তখন ভালো তো লেগেছে অবশ্যই৷ এর ভালো দিক রয়েছে, পাশাপাশি খ্যাতির বিড়ম্বনাও৷ আমরা তো এমনিতেই আবেগপ্রবণ জাতি৷ অল্প বয়সের সাফল্য অনেকের জন্যই খ্যাতির বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায়৷ তখন অনেকে খেলাধূলার বাইরে গিয়ে খ্যাতি নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন...
আপনার নিজেরও কি অমন হয়েছিল? ক্রিকেটের চেয়ে খ্যাতির দিকেই ছুটছিলেন বেশি?
আমার ক্ষেত্রে ঠিক সেটিই হয়েছিল৷ এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলের সবারই বয়স কম৷ ওরা সাফল্য এনেছে৷ বিশ্বকাপ জেতা এক বিরাট ব্যাপার৷ এখন এই ছেলেদের মনোযোগ ক্রিকেট থেকে সরে যেন খ্যাতির দিকে ঝুঁকে না যায়, সে জায়গায় আমাদের সবারই বড় দায়িত্ব৷ সেজন্য ওদের বছরজুড়ে ক্রিকেটে আরো ব্যস্ত রাখা যেতে পারে৷
প্রশ্ন : অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম অংশ নেয় ১৯৯৮ সালে৷ আপনি সে দলের অংশ৷ সেবার প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ৷ সে টুর্নামেন্টের কোন স্মৃতি মনে আছে?
মেহরাব : ২২ বছর আগের সব স্মৃতিই মনে আছে৷ তখন প্লেট চ্যাম্পিয়ন হওয়াই আমাদের কাছে বিরাট পাওয়া৷ ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারাই৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলকে হারাই প্লেট ফাইনালে৷ সে দলে ক্রিস গেইল ছিলেন; ফাইনালে তাঁর ১৫০ রানের উপরে একটি ইনিংস ছিল (আসলে ১৪১*)৷ ওই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের স্মৃতি এখনও আমার মাঝে শিহরণ জাগায়৷ এবার ২২ বছর পর বাংলাদেশ একই টুর্নামেন্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হল৷ এটি অবশ্যই বিরাট বড় অর্জন৷
প্রশ্ন : এবার আপনার সেই সেঞ্চুরির কথা যদি বলেন৷ ১৯৯৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটি ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানেরই প্রথম৷ এর আগে আপনার চাচা আজহার হোসেন শান্টু করেন দেশের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি; ১৯৯০ সালে অস্ট্রাল-এশিয়া কাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে৷ দুজনের এমন কীর্তি নিশ্চয়ই আপনার পরিবারের বড় গৌরব?
মেহরাব : অবশ্যই৷ আমার অনুপ্রেরণা চাচার ফিফটি থেকেই পাওয়া৷ তখন ডিশ এন্টিনার যুগ ছিল না৷ টেলিভিশন এন্টেনায় হাড়ি-পাতিল লাগিয়ে দূরদর্শনে খেলা দেখতাম৷ এখনও চাচার হাফ সেঞ্চুরির সে দিনটি মনে আছে৷ বাবার কোলে বসে দূরদর্শনে খেলাটি দেখছিলাম৷ চাচা ফিফটি করে আউট হবার পর বাবা আমাকে খুব আহলাদ করে বলেন, ‘‘বাবা, তুমি বড় হয়ে দেশের প্রথম সেঞ্চুরি করে দেখাবে৷'' বাবাকে কথা দিয়েছিলাম৷ তবে সেটি ছিল ছোট্ট একটি ছেলের বাবাকে আহলাদ করে বলা৷ পরবর্তীতে তা যে বাস্তবে রূপ নেবে, কখনো ভাবিনি৷ তবে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হবার স্বপ্ন দেখছিলাম তখন থেকেই৷
প্রশ্ন : যে প্রতিযোগিতায় সেঞ্চুরি করলেন, সেই মেরিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে তো একাদশেই ছিলেন না৷ সে খেলায় আরেক ওপেনার শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ সেঞ্চুরি প্রায় করেই ফেলেছিলেন৷ শেষে আউট হন ৯৫ রানে৷ তখন কি মনে এমন ভাবনা এসেছিল যে, বিদ্যুৎ সেঞ্চুরি করলে তো আমার বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান হওয়া হবে না?
মেহরাব : এটি সত্যি যে, অনেক ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছিলাম৷ ও যখন ৯০-এর ঘরে, তখন ড্রেসিংরুমের অনেকে বলছিলেন, বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি হতে যাচ্ছে৷ সে সময়ে আমি মোটেও খুশি ছিলাম না৷ বাবার কথা মনে পড়ছিল৷ মনে পড়ছিল, চাচা প্রথম হাফ সেঞ্চুরিয়ান এবং আমি প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হব বলে বাবাকে কথা দিয়েছিলাম৷ তাই চাইছিলাম না যে, বিদ্যুতের সেঞ্চুরি হোক৷ শেষে তো হলই না (হাসি)৷ পরের ম্যাচে একাদশে সুযোগ পেয়ে ৭৮ রান করে নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হই...
৭৩ রান, জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে৷
হ্যাঁ, ৭৩৷ এতে আমি খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি৷
কেনিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচে ২৩ রানের পর জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরি৷ যে সেঞ্চুরির উপহার হিসেবে বিশেষ এক উপহার পান সাবেক ক্রিকেটার ইউসুফ বাবুর কাছ থেকে৷ সে গল্প শুনেছি আগে৷ যদি আবার একটু বলেন...
ইউসুফ বাবু ভাইয়ের সে উপহার এখনো আমার শো কেসে সাজানো৷ উনি একটি ক্যাপ উপহার দেন৷ ১৯৯৯ বিশ্বকাপ খেলার জন্য যখন ইংল্যান্ডে যাই, তখন৷ উনি ক্যানাডায় থাকতেন৷ সেখান থেকে ক্যাপটি নিয়ে আসেন৷ এমনিতে ইউসুফ বাবু ভাই আমার আদর্শ ব্যাটসম্যান৷ ছোটবেলায় চাচার হাত ধরে যখন মাঠে যেতাম, তখন ইউসুফ বাবু ভাইয়ের ব্যাটিংই সবচেয়ে ভালো লাগত৷ ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬৪ রান করার পর সে রাতে উনি আমাদের হোটেলে আসেন সহধর্মিনীকে নিয়ে৷ সবার সামনে ক্যাপটি বের করে উপহার দেন আমাকে৷ ক্যাপের উপর লেখা ছিল, ‘হিস্টোরিকাল ১০১, ২৫ মার্চ ১৯৯৯'৷ আমি জীবনে যত পুরষ্কার পেয়েছি, তার মধ্যে সেঞ্চুরির পুরস্কার হিসেবে পাওয়া এটি আমার অন্যতম প্রিয়৷
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যে ম্যাচের কথা বললেন, সেদিন গড়লেন আরেক ইতিহাস৷ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ফিফটিও আসে আপনার ব্যাট থেকে৷ এটিও নিশ্চয়ই আরেক গর্বের জায়গা?
অবশ্যই৷ ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান কিংবা বিশ্বকাপে প্রথম ফিফটি করা ব্যাটসম্যান হিসেবে আমার নামটি যখন উঠে আসে, তখন খুব গর্ব বোধ করি৷
প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটি যে করতে পারেননি, এ নিয়ে আক্ষেপ?
মেহরাব : এ আক্ষেপ এখনো আছে৷ এটি আমার কাছে একটি অসম্পূর্ণ ব্যাপার যে, টেস্টে আমার একটি সেঞ্চুরি নেই৷
টেস্টে দেশের প্রথম সেঞ্চুরি কিংবা সব মিলিয়েই টেস্ট সেঞ্চুরি না থাকার কথা বলছেন?
হ্যাঁ৷
সামগ্রিক অর্থে ক্যারিয়ার নিয়েও আপনার অতৃপ্তি রয়েছে কিনা? দেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানদের একজন হিসেবে এখনো বিভিন্ন আড্ডায় আপনার নাম উচ্চারিত হয়৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নয় টেস্টে এক ফিফটিতে ২৪১ রান এবং ১৮ ওয়ানডেতে এক সেঞ্চুরি, দুই ফিফটিতে ৪৪৯ রান৷ পেছন ফিরে তাকালে কতোটা আফসোস হয়?
জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর প্রথম প্রথম আফসোস করতাম৷ এখন খুব একটা করি না৷ তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট মাত্র হামাগুড়ি দিয়ে চলা শুরু করেছে৷ একটি ফিফটি করলেও বিরাট পাওয়া৷ সেদিক থেকে মনে হয়, আমি বাংলাদেশের হয়ে যতটুকুই খেলেছি, তাতে তৃপ্ত৷ তবে এক দিক দিয়ে আক্ষেপ আছে, ক্যারিয়ার হয়তো আরেকটু লম্বা হতে পারত৷
বাংলাদেশের জার্সিতে শেষ ম্যাচ খেলেন মাত্র ২৫ বছর বয়সে৷ এ নিয়ে নিশ্চয়ই কষ্ট আছে?
কষ্ট তো আছেই৷ ওই যে বললাম, ক্যারিয়ার আরেকটু লম্বা হতে পারত৷ দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি; সেটি নিজের জন্য হোক৷ আমার কাছে মনে হয়, নিজের উপর একটু বেশি অত্যাচার করেছিলাম বলেই হয়তো ক্যারিয়ারটা লম্বা করতে পারিনি৷ কিন্তু নিজে যা করতে পারিনি, এখন ক্রিকেট কোচিংয়ে এসে সেটিই ছেলেদের বোঝানোর চেষ্টা করছি৷ কিভাবে আরো পরিণত হওয়া যায়, তাও শেখাচ্ছি...
কিংবা নিজের উপর কিভাবে কম অত্যাচার করা যায়...
সেটাই৷ ওরা বিপথগামী যেন না হয়৷ সবাই ভুল থেকেই শিক্ষা নেয়৷ জীবনের ভুল থেকে আমি অনেক শিক্ষা নিয়েছি৷ যাদের ক্রিকেট খেলা শেখাচ্ছি, অবশ্যই চাইব না, ওদের ভেতর আমার জীবনের ভুলগুলো দেখতে৷ আমি চাই, ওরা যেন এসব থেকে দূরে থাকে৷ কিভাবে সুন্দর জীবনযাপন করা যায়, সুন্দর ক্রিকেট খেলা যায়, ওদেরকে সেসব শেখানোর দিকেই আমি মনোযোগ দিই৷
অনূর্ধ্ব-১৯ দিয়ে শুরু করেছিলাম, অনূর্ধ্ব-১৯ দিয়েই শেষ করি৷ এই ছেলেগুলো ১৭-১৮-১৯ বছর বয়সে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে৷ বিস্তর নাম-যশ-খ্যাতি পেয়েছে; পুরো দেশ ওদের মাথায় তুলে রেখেছে৷ আপনার মতোই অনেক কম বয়সে খ্যাতি পেয়ে যাওয়া এই উত্তরসূরীদের প্রতি আপনার বার্তা কী থাকবে?
এ বার্তাই থাকবে, ক্রিকেটে আরো বেশি মনোনিবেশ করা উচিত৷ অল্প বয়সে অনেক খ্যাতি এসে পড়েছে৷ তবে খ্যাতির তো শেষ নেই৷ এখনো অনেক কিছু বাকি৷ আমরা একজন সাকিব আল হাসানের দিকে তাকিয়ে দেখি৷ সাকিবের মতো ক্রিকেটার হওয়ার প্রতিজ্ঞা যদি ওরা করে, তাহলে সাফল্য পাবে৷ এটি মনে রাখতে হবে, বেশি যশ পাবার পর যেন ক্রিকেট থেকে দূরে সরে না যায়৷ এই দূরে সরে যাওয়াটাই আমার কাছে মনে হয় নিজের প্রতি অত্যাচার করা৷ সাকিবের উদাহরণ ওদের সামনে থাকলে খ্যাতির এই বিড়ম্বনা বা চাপ ওরা সামলাতে পারবে৷