আবহাওয়ায় বাড়ছে প্রযুক্তিনির্ভরতার প্রভাব
২ মে ২০২৪বিরূপ আবহাওয়ার মুখোমুখি বাংলাদেশ। এপ্রিল মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কিছু দিন ৪০ ডিগ্রি সেলিসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের দেওয়া তথ্যমতে, গেল মাসের ৩০ দিনে অন্তত ১৩ দিন চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে ৩০ এপ্রিল মঙ্গলবার তাপমাত্রা ছিল ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ৩৯ বছরের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে জানান চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ জামিনুর রহমান।
তীব্র গরমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। যাদের নেই, তাদের কেউ কেউ ছুটছেন বিক্রয়কেন্দ্রে। তবে এসির বিক্রি এত বেড়েছে যে, টাকা নিয়ে গিয়েও মিলছে না তা, নিজের অভিজ্ঞতা জানালেন রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মশিউর রহমান। তিনি আরো বলেন, যে ব্র্যান্ডের এসি কিনতে চান, তার সব আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রয়কর্মীরা তাকে পরদিন আসতে বলেছেন। তার মতো বেশ কয়েকজন ক্রেতা সেদিন ফিরে গেছেন, জানালেন মশিউর।
গরমের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবার এসি বিক্রি বেড়েছে। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)-র গবেষণামতে, রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর এসির ব্যবহার বাড়ছে ২০ শতাংশ করে।
গতবছর দেশে বাসস্থানে মোট চার লাখ এসি সংযোজিত হয়েছে, চলতি বছর নতুন যুক্ত হতে পারে আরো ৫ লাখ, এই হিসাব খাতসংশ্লিষ্টদের।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান মনে করেন, গরমে সাময়িক আরাম মিললেও এসি কোনো সমাধান নয়, বরং এর কারণে তাপমাত্রা আরো বাড়ছে । ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এসি ঘর ঠান্ডা করতে তাপমাত্রা বাইরে নিয়ে যায়, যা পরিবেশে জমা হতে থাকে। ফলে প্রান্তিক মানুষ সেই তাপের ভুক্তভোগী হয়। নগরজুড়ে যখন অবস্থাসম্পন্নরা ঘরে ঘরে এসি ব্যবহার করে, তখন তার কারণে বাইরের প্রান্তিক স্তরে তাপপ্রবাহ আরো দীর্ঘায়িত হয়।''
এসির কারণে লোডশেডিং বাড়ছে এবং বিদ্যুৎ বিতরণেও বৈষম্য তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘‘ফ্যানের তুলনায় এসি চালাতে বিদ্যুৎ অনেক বেশি খরচ হয়। ফলে যে এলাকায় এসির বেশি ব্যবহার, সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কারণে শহরের অন্য এলাকায় বা গ্রামে লোডশেডিং করতে হয়।'' এসব দিক চিন্তা করে এসির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সরকার থেকে একটি গাইডলাইন করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
লাগাম টানতে হবে দূষণে
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য যেসব গ্রিনহাউস গ্যাস দায়ী, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হাইড্রোফ্লোরোকার্বন (এইচএফসি)। কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় তা ১০ হাজার গুণ বেশি ক্ষতিকর বলে মনে করেন গবেষকরা। রেফ্রিজারেটর ও এসিতে এই এইচএফসি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে প্রায় ২০০ দেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০১৬ সালে। এর মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব পরিবেশবান্ধব রেফ্রিজারেটর ও এসির ব্যবহার নিশ্চিতে কাজ করছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এমন কিছু করবে ২০২৮ সালের পর।
এদিকে বায়ুদূষণে প্রায়ই বিশ্বের শীর্ষ শহরের তালিকায় থাকছে ঢাকা। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার দূষণের অন্যতম উৎস ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণাধীন ভবনের ধুলো।
ঢাকার রাস্তায় চলাচলরত ফিটনেসবিহীন যানবাহন পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফিটনেসবিহীন যানবাহন কার্বন বেশি ছাড়ে। এর কারণে পরিবেশ দূষণ যেমন হয়, তেমনি তাপমাত্রাও বাড়াতে পারে। যানবাহনজনিত পরিবেশ দূষণ শহরেই বেশি। কিন্তু গ্রামেও জলাশয় অনেক শুকিয়ে যাচ্ছে, নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, নগরবিদ নজরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘‘গ্রামের পরিবেশও একটু একটু করে শহুরে হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে ভবন হচ্ছে, রাস্তাঘাট হচ্ছে, বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। ফলে রেফ্রিজারেটরের ব্যবহার বাড়ছে। এমনকি এসিও লাগানো হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে জীবনমানের উন্নতি হয়। বিপরীতে বর্জ্য বেশি করে উৎপন্ন হয়, বায়ুদূষণ হয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।'' গ্রামের পরিবেশ ঠিক রাখার দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা যেভাবে পরিণত হচ্ছে উত্তপ্ত দ্বীপে