আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বড় ধরনের গবেষণা দরকার
২৫ মার্চ ২০১৯ডয়চে ভেলে: গণহত্যা নিয়ে গবেষণা কেমন হয়েছে?
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: না, আসলে গণহত্যা নিয়ে সেই পরিমাণে গবেষণা কম৷ তবে গবেষকদের আগ্রহ বাড়ছে৷ অন্যান্য দেশের ‘জেনোসাইড' নিয়ে যদি তুলনা করি তাহলে আমাদের গবেষণা কম৷
১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছেন৷ এখনো কেন তাহলে এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান?
এর দু'টো কারণ হতে পারে৷ একটা হলো ‘জেনোসাইড’ শব্দটার আইনগত যে বিষয় আছে, যাঁরা বিতর্ক করছেন তাঁরা হয়ত এই শব্দের মানেটা সেভাবে জানেন না৷ এখানে সংখ্যাটা বিষয় না৷ অনেকে মনে করেন, ‘জেনোসাইড' হতে হলে সংখ্যাটা অনেক হতে হবে৷ বিষয়টা আসলে তা নয়৷ আসলে ‘জেনোসাইড’-এর অনুবাদটা ঠিক হয়নি৷ গণহত্যা যেমন ‘জেনোসাইড' হতে পারে, তেমনই গণহত্যা ছাড়াও ‘জেনোসাইড' হতে পারে৷ এমনকি মানুষের মৃত্যু না হলেও ‘জেনোসাইড' হতে পারে৷ অনেকে মনে করেন, সংখ্যাটা বাড়লেই ‘জেনোসাইড' হয়৷ এটা ছিক নয়৷ আরেকটা কারণ, এটা নিয়ে যেহেতু কোনো জরিপ হয়নি, তাই সবাই মনে করছেন এই সংখ্যাটা কোথা থেকে আসল? যদি হিসাব করা যায় তাহলে সংখ্যাটা আরো বাড়তে পারে৷ তখন যে ১০ মিলিয়ন মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের গর্ভপাত হয়ে গেছে, অসুখে মারা গেছেন – এগুলো কিন্তু হিসেবে আনতে হবে৷ কারণ ওগুলো তো কোনোটাই স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না বা তাঁরা নিজের ইচ্ছায় সেখানে যাননি৷ বাধ্য হয়েই তাঁদের যেতে হয়েছে৷ সংখ্যা নয়, আসলে ‘ইনটেনশন' কী ছিল সেটাই আসল কথা৷
এই গণহত্যার এখনো স্বীকৃতি মেলেনি কেন?
এর জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন৷ আমরা হয়ত কিছু কথা বলতে পারি৷ কিন্তু এর জন্য বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা প্রয়োজন৷ এখন অবশ্য আর্ন্তজাতিকভাবে ‘জেনোসাইড' নিয়ে কিছু লেখালেখি হচ্ছে এবং সেখানে বাংলাদেশের কথাও আছে৷ তবে যেটা নেই, সেটা হলো জাতিসংঘের স্বীকৃতি এখনো আসেনি৷ এর মধ্যে একটা রাজনীতি আছে, আরেকটা যেটা বললাম গবেষণা হওয়া দরকার৷ ‘আলজেরিয়ান জেনোসাইড'-এর স্বীকৃতি পেতে কিন্তু ১০০ বছর লেগেছে৷ প্রচুর গবেষণা হয়েছে বলেই সেটা এক সময় এসে স্বীকৃতি পেয়েছে৷ তাই গবেষণা ব্যতিত এই স্বীকৃতি কিন্তু কোনোভাবেই সম্ভব না৷ যদি বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করা হয়, তাহলে আজ না কাল জাতিসংঘের অনুমোদন অবশ্যই পাওয়া যাবে৷ তাতে সমস্যা হবে না৷
এ নিয়ে মত-দ্বিমত কীভাবে দূর করা যায়?
এখানে আসলে সংখ্যাটা বিষয় না৷ ১০ জন মারা গেলেও ‘জেনোসাইড' হতে পারে, আবার ১০০ জন মারা গেলেও হতে পারে৷ এখানে ‘জেনোসাইড'-এর বাংলা করা হয়েছে গণহত্যা, যার ইংরেজি ‘মাসকিলিং'৷ ‘মাসকিলিং' অবশ্যই গণহত্যা হতে পারে, কিন্তু সব ‘মাসকিলিং' কিন্তু গণহত্যা নয়৷ যেমন ধরুন অ্যামেরিকানরা যে আফগানিস্তানে বোমা ফেলছে, সেটা কিন্তু ‘জেনোসাইড' না৷ তারা কিন্তু একদল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মারার চেষ্টা করছে৷ এখানে হয়ত সাধারণ মানুষও মারা যাচ্ছে, তারপরও এটা ‘জেনোসাইড' হবে না৷ ‘জেনোসাইড' হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি শব্দ৷
আপনি বারবারই গবেষণার কথা বলছেন৷ এটা কীভাবে হতে পারে? রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে না ব্যক্তি পর্যায় থেকে?
এটা যৌথভাবে হতে পারে৷ একটা ‘ফেলোশিপ' অথবা একটা ‘স্কলারশিপ' দিয়ে তো হতেই পারে৷ এই ‘জেনোসাইড' নিয়ে যদি প্রতি বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মেলন করা হয় তাহলে কিন্তু বিশ্ববাসীও এ বিষয়ে জানবে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চার-পাঁচ বছর ধরে এটা করছে৷ আমরা একটা ‘সেন্টার' করেছি, যার নাম ‘সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ'৷ এটা যদি আগে করা হতো, তাহলে গবেষণাটা অনেক এগিয়ে যেত৷ এখানে ডিপ্লোমা কোর্স হচ্ছে, মানুষ জানছে যে আসলে ‘জেনোসাইড' কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু প্রতি বছর একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে৷ ক'বছর ধরে এটা হচ্ছে৷ এবারও ২৪ ও ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা আয়োজিত হবে৷ এটা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে করা যায় – সেটা দেশে হতে পারে আবার দেশের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে – তাহলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা আসবেন, তাঁরাও বিষয়টা জানবেন৷
আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের আইন-কানুন কী?
এটা সরকারিভাবে জাতিসংঘে পেশ করতে হবে৷ তবে এই ধরনের প্রস্তাব আনার আগে বড় আকারের গবেষণা দরকার৷ যখন টেবিলে সেই গবেষণা দেওয়া হবে, তখন যেন কারো মনে কোনো প্রশ্ন না থাকে৷ সেই ধরনের গবেষণা হতে হবে৷ সরকারি চ্যানেলেই জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেতে হবে৷
বাংলাদেশ সরকারের এক্ষেত্রে কী করা উচিত?
কয়েকটা জিনিস করতে হবে৷ প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে আন্তর্জাতিক কনফারেন্স বা সম্মেলন করতে হবে দেশে এবং বিদেশে৷ সেই আলোচনায় অন্য সব ‘জেনোসাইড'-ও আসতে পারে৷ দ্বিতীয়ত যে গবেষণার কথা বলা হচ্ছে, তার জন্য সরকারের বড় আকারের একটা বাজেট দরকার৷ সময়ও প্রয়োজন৷ তিন-চার বছর ধরে যদি গবেষণা করা যায়, তাহলে ভালো ‘রিপোর্ট' আসতে পারে৷ এছাড়া একটা ‘ক্যাম্পেইন' করা দরকার৷ দূতাবাসগুলো এক্ষেত্রে কাজ করতে পারে৷
এত বছর পর গণহত্যার একটা ভালো চিত্র পাওয়া কি সম্ভব?
এটা অসম্ভব না৷ নাৎসি গণহত্যা নিয়ে এখনো কাজ হচ্ছে৷ আলজেরীয় গণহত্যা নিয়ে এখনো কাজ হচ্ছে৷ অনেক দেশেই, যেখানে বড় বড় ‘মাসকিলিং' হয়েছে, সেখানেও এখনও গবেষণা হচ্ছে৷ বিজ্ঞানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ এখন ডিএনএ পরীক্ষা করা যায়৷ তাই অনেক কিছুই করা সম্ভব৷ এখানে শুধু সমাজবিজ্ঞানী না, বিজ্ঞানীরাও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন৷ আমাদের ৭১-এর ব্যাপারে খুব একটা সমস্যা হবে না৷ এখনও প্রচুর তথ্য-উপাত্ত রয়ে গেছে৷ বহু তথ্য সংগ্রহ করা আছে৷ তবে পরে এগুলো জার্মান, ফরাসি বা ইংরেজি ভাষায় করতে হবে৷ শুধু বাংলায় করলে হবে না৷ এখানে অনুবাদেরও কিছু বিষয় আছে৷ এর সঙ্গে ইংরেজি ভাষাতেও কাজ বাড়ানো দরকার৷
গণহত্যার স্বীকৃতিতে দেশের কী লাভ? না পেলে ক্ষতিই বা কী?
গণহত্যার বিচার এই জন্য করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে৷ ১৯৭১-এর পরও কিন্তু কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডাতে বড় ধরনের ‘জেনোসাইড' হয়েছে৷ বলতে গেলে বাংলাদেশ আবারো ‘জেনোসাইড'-এর শিকার হয়েছে প্রতিবেশী মিয়ানমারের কারণে৷ এটা ঢেকে রাখা যাবে না৷ পাকিস্তানিদের নিয়ে যদি ‘জেনোসাইড'-এর বিচার করা যেত, তাহলে এখন সেখানে যে ধরনের ‘কিলিং' হচ্ছে সেটা হয়ত হতো না৷ আমি মনে করি, তাহলে পাকিস্তানের ‘মরাল স্ট্যান্ডিং'-টা আরো বাড়ত৷ যেমন ধরুন যারা ‘জেনোসাইড' করেছে, তারা বড় বড় ‘পোস্ট' পেয়েছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ এর ফলে রাষ্ট্রের মধ্যে একটা ঘুন ধরে গেছে৷ যার বড় উদাহরণ পাকিস্তান৷ এ সমস্ত ঘটনার বিচার না হলে ঘুরে-ফিরে মানুষের মধ্যে এটা রয়ে যায়৷ এবং পরে আবারো বড় আকারে দেখা দেয়৷ সর্বপরি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এর বিচার করা ভীষণভাবে দরকার৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷