আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনে রূপ নিয়েছে জেএমবি!
২৫ জুলাই ২০১৮দু'দিন আগে ভারতের উত্তর প্রদেশের গৌতম বুদ্ধনগর জেলার বৃহত্তর নয়ডার সুরজপুর থানা এলাকা থেকে মোশারফ হোসেন ওরফে মুসা ওরফে তেজরুল ইসলাম ওরফে রেজাউল করিম এবং রুবেল আহমেদ ওরফে মনিরুল ইসলাম নামে দুই ব্যক্তি আটক হন৷ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জেএমবির সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় পুলিশ৷
ভারতীয় পুলিশ এরইমধ্যে বাংলাদেশের কাছে ঐ দু'জনের ব্যাপারে তথ্য চেয়েছে৷ পুলিশ সদরদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এরইমধ্যে তারা ঐ দু'জনের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছেন৷ তিনি জানান, ‘‘ভারতে গ্রেপ্তার দু'জনের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর থানার টেংরিয়া গ্রামে৷ মোশারফ হোসেন মুসার বাবার নাম হাসান আলী৷ মুসা লেখাপড়া করেছে ময়মনসিংহের একটি মাদ্রাসায়৷ সে খুব ভালো ফুটবল খেলতো৷ আর রুবেল আহমেদ বড় হয়েছে তার নানাবাড়ি সিলেটে৷ সেও মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে৷ মুসা ও রুবেলের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই৷ তবে তারা একই এলাকার হওয়ায় পরিচিত৷ তাদের পারিবারিক অবস্থা তেমন ভালো না৷''
এই দুজনের কারোর বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় কোনো নাশকতার মামলা নেই৷ পুলিশ তাদের ব্যাপারে আরো অনুসন্ধান করছে৷
পুলিশ সদরদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘তারা নিজ এলাকায় কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে এমন তথ্য এখনও পাইনি৷''
ভারতীয় পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, ‘‘প্রায় আড়াই মাস আগে ঐ দু'জন দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে৷ তাঁদের পরিকল্পনা ছিল দিল্লি ও এর আশপাশে এলাকায় নাশকতা চালানো৷ আগামী ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল তারা৷ তাঁদের বিরুদ্ধে ঢাকায় ব্লগার হত্যাসহ হোলি আর্টিজান হামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷''
ভারতীয় পুলিশ আরো জানাচ্ছে, ‘‘কয়েকমাস আগে কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে বাংলাদেশের দুই জঙ্গি জামশেদ আলী ওরফে রিয়াদ হোসেন ও আইসুল রহমান ওরফে আনিসুরকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধগয়ার হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল৷ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই এই দু'জনের নাম জানা গেছে৷ ততক্ষণে তারা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে উত্তর প্রদেশে পালিয়ে যায়৷ আর সেখান থেকেই তাদের আটক করা হয়৷''
ভারতীয় পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখার বিশেষ বাহিনী (এসটিএফ) তাদের আটক করে৷
দেশের বাইরে বিস্তার
বাংলাদেশের জঙ্গি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০০১ সালে জেএমবি বাংলাদেশে তৎপরতা শুরুর পর থেকেই ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল৷ জঙ্গি বিষয়ক গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জন্মলগ্ন থেকেই জেএমবির কার্যক্রম ভারতে ছিল৷ তাদের নথিপত্রে পশ্চিমবঙ্গে জেএমবির একটি আঞ্চলিক শাখা থাকার কথা জানা যায়৷ বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে তথ্য দিয়েছে যে, জেএমবি ভারত থেকে ডেটোনেটর ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করেছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এই ধরণের জঙ্গি সংগঠন একটি ভৌগলিক সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা৷''
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ-এর প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বেশ কিছু দিন ধরেই জেএমবি ভারতের কয়েকটি জায়গায় তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে৷ পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলায়জেএমবি'র ব্যবহার করা পয়েন্ট সিক্স এক্সপ্লোসিভ পাওয়া যায়৷ বালুঘাটসহ আরো কয়েকটি হামলায় এই বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়৷ আর তখন থেকেই স্পষ্ট হয় যে, জেএমবি শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও তাদের তৎপরতা বাড়াচ্ছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তবে সম্প্রতি আরো কিছু বিষয় লক্ষ্যণীয়৷ তিন-চার সপ্তাহ আগে জেএমবি'র পক্ষ থেকে একটা ঘোষণা আসে যে, তারা বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতে তাদের নতুন চ্যাপ্টার ওপেন করছে৷ আর তার নাম দেয়া হয় জামাআতুল মুজাহেদিন আই বা ইন্ডিয়া৷ কিন্তু গত এক সপ্তাহে তাদের যেসব তথ্য বিভিন্নভাবে জানা যায় তাহলো তারা জামাআতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ বা ইন্ডিয়া উঠিয়ে দিচ্ছে৷ তারা এখন জামাআতুল মুজাহেদিন৷ তারা জেএমবিকে এখন আঞ্চলিক সংগঠনে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে বা করে ফেলেছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘জেএমবি পুরোপুরি তৎপর আছে এবং তারা তাদের পরিধি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে অন্যদেশেও সম্প্রসারিত করেছে৷''
জঙ্গি বিষয়ক বইয়ের লেখক, গবেষক এবং বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের পার্টনার বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার নুরুজ্জামান লাবু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জেএমবি এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হিসেবে কাজ শুরু করেছে৷ এখন তারা জামাআতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ নয়৷ তাদের নতুন নাম জামাআতুল মুজাহেদিন৷ তারা বাংলাদেশ ও ভারতের সংগঠনকে শাখা হিসেবে দেখছে৷ আরো কয়েকটি দেশে শাখা খোলার চেষ্টা করছে তারা৷''
তিনি জানান, ‘‘আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে জেএমবির কথিত আমির সালেহীন এখন ভারতেই আছেন৷ তিনি সেখান থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন৷ বাংলাদেশে জেএমবি জঙ্গিরা গোড়া থেকেই অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়৷ এখন আবার তাদের অর্থ সংগ্রহের এই পদ্ধতি জোরদার করেছে৷ তারা তাদের অর্থের একটি অংশ যারা কাজ করে তাদের জন্য, একটি অংশ যারা কারাগারে আছে তাদের পরিবারকে এবং আরেকটি অংশ কেন্দ্রীয় সংগঠনকে দেয়৷''
বিশ্লেষকরা বলছেন, জেএমবি এখন নতুনভাবে সংগঠিত হচ্ছে৷ তৎপরতা দেশের বাইরেও ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে৷ তারা সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জে লেখক ও প্রকাশককে হত্যা করে তার প্রমাণ রেখেছে৷ তারা এখন বিভিন্ন ঘটনায় ভিডিও বার্তা প্রকাশ করছে৷ নুরুজ্জামান লাবু বলেন, ‘‘জেএমবি আল-কায়েদার অনুসারী৷ তারা নতুনভাবে কাজ শুরু করলেও হোলি আর্টিজান হামলায় জড়িত নব্য জেএমবি দুর্বল হয়ে পড়েছে৷''
নূর খান বলেন, ‘‘জেএমবি বা এই ধরণের সংগঠন দুর্বল হয়ে গেছে ভাবা ঠিক নয়৷ তারা যে-কোনো সময় আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে৷''
আর মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুর্বলতো নয়ই, জেএমবি এখন দেশের সীমানার বাইরে তাদের কার্যক্রম বাড়িয়েছে৷''