‘আধুনিক' রাষ্ট্রের ‘মধ্যযুগীয়' আইন
২৬ জুন ২০২০সমাজ এমনিতেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের মাধ্যমেও যদি তার বৈধতা দেয়া হয় ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশের যথেষ্ট কারণ থাকে বৈ কি৷ কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো উপমহাদেশই যেন শত শত বছর ধরে এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে৷ সম্রাট, রাজা, জমিদারদের বিরুদ্ধে কিছু বললেই ছিল গর্দান যাওয়ার রীতি৷ শত শত বছরের নির্যাতন কাটিয়ে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রে জনগণ অন্তত প্রাণ খুলে সমালোচনার অধিকারটুকু পেতেই পারতো৷ কিন্তু না, সে ভাগ্য তাদের কপালে জুটলো না৷
বাংলাদেশে এখন মনে হয় সবচেয়ে বড় আতঙ্কের শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘কটূক্তি'৷ কে কখন কোন কথায় কাকে কটূক্তি করে ফেলছেন, কে জানে! সেজন্য আবার একটা আইনওতৈরি হয়েছে, যে আইনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে জামিন ছাড়াই কাউকে আটকে রাখা যায়৷ ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন আটকের ঘটনা ঘটেছে৷ কিন্তু এর সবকটিতেই আনা হয়েছে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে কাউকে আক্রমণ করা বা কোনো অপরাধ ঘটানোর উসকানি দেয়ার অভিযোগ৷ কিন্তু ‘কটূক্তির' কারণে গ্রেপ্তার করে রিমান্ড দেয়ার ঘটনা অবাক হওয়ার মতোই বটে৷
অনেক খুঁজেও কোনটা সমালোচনা, আর কোনটা কটূক্তি এমন তফাত করার মতো কোনো সংজ্ঞা সরকার বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পেলাম না৷ সংসদে মাঝেমধ্যে বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে যে ভাষায় মন্তব্য করা হয়, সেগুলো কি কটূক্তির আওতায় পড়ে? সরকার দলের রাজনীতিবিদরা যে ইচ্ছেমতো ভাষায় ইচ্ছেমতো বিশেষণ ব্যবহার করে অন্যদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও নানা মন্তব্য করেন, সেগুলো কি কটূক্তির আওতায় পড়ে?
একের পর এক সাংবাদিককেএই আইনে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ এই আইন পাসের আগেই সাংবাদিকরা সংশয়ে ছিলেন যে আইনটিকে তাদের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হবে৷ সরকার প্রতিবারই আশ্বাস দিচ্ছিলো যে এমন কখনই হবে না৷ এখন যখন সত্যি সত্যিই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইন কাজে লাগানো হচ্ছে, তখন দেশজুড়ে শত শত সাংবাদিক সংগঠনের আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না৷
কোনো সংবাদ নিয়ে কারো আপত্তি থাকলে প্রেস ইনস্টিটিউট আছে, সাধারণ আইনে তা চ্যালেঞ্জে করারও উপায় রয়েছে৷ কিন্তু আমরা এখন দেশে আইনকে থোড়াই কেয়ার করছি৷ বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যে তাও নায়ক ভিলেনকে ইচ্ছেমতো মারধর করার পর পুলিশ এসে ‘আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার' অনুরোধ করতো৷ কিন্তু বাস্তবে খোদ পুলিশের বিরুদ্ধেই আইন হাতে তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠছে, অভিযোগ উঠছে যারা আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন তাদের ছত্রচ্ছায়া দেয়ারও৷
একদিকে কিছু মানুষ নিজের কথা বলার অধিকারও না পেয়ে সন্দেহের বশে গণপিটুনি-কোপ খেয়ে মরছে, অন্য কিছু মানুষ ইউনিফর্মধারীদের সঙ্গে ‘অভিযানে গিয়ে‘ ‘আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা সহযোগীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে' মরে যাচ্ছে৷ আর তৃতীয় একদল মানুষ ‘ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে আইনী প্রক্রিয়ায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷
সবার সঙ্গে আপনি একমত নাই হতে পারেন, কিন্তু তার কথা বলার অধিকারটুকু রক্ষা করার নামই গণতন্ত্র৷ কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছে ঠিক তার উলটো৷ কথা বলতে চাইলেই তাকে নানাভাবে চুপ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, নিজের মতটাকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ এবং দুঃখজনক সত্য হলো এ পরিস্থিতি ক্রমশ আরো আঁটোসাঁটো হয়ে আসছে৷
করোনা নিয়ে ‘গুজব' ছড়ানোর জন্যও এই ডিজিটাল আইনে গ্রেপ্তার করা যায়৷ অথচ আমরা শুরু থেকে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে করোনা বিষয়ক কত গালগল্প শুনে আসছি৷ তিন মাস আগেই শুনলাম ‘বাংলাদেশ প্রস্তুত', ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী', এখন যখন সব লেজেগোবরে অবস্থা সেই জবাবদিহিতা চাইলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন?
খোদ সরকারের জাঁদরেল মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ২০১৮ সালে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘‘আপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে।'' সরকারের পক্ষ থেকে এই কথার তেমন কোনো প্রতিবাদ আমার চোখে পড়েনি৷
এই আইনকে ‘মধ্যযুগীয়' বলাটাও কটূক্তি হলো কিনা কে জানে!
প্রায় শত বছর আগে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে' প্রকাশ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ৮ নভেম্বর পত্রিকার সেই সংখ্যা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হন নজরুল। নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
প্রায় শত বছর আগে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক কবিতা লেখার কারণে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যখন সাজা ভোগ করছিলেন নজরুল, তখন তার বয়স কেবল ২৪ বছর৷
কবি কী জানেন এখন আর তার বয়সিদের নিজে কবিতা লিখতেও হয় না, গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য অন্যের লেখা গানের কলি ফেসবুকে শেয়ার দেয়াই যথেষ্ট?
‘‘বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক' মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
১৯২৬ বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন ‘আমার কৈফিয়ত' কবিতাটি লিখেছিলেন, তখন তার বয়স কেবল ২৭৷