1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আদালতের নির্দেশের পরও কেন মন্দারমণিতে হোটেল ভাঙা হচ্ছে না?

২১ নভেম্বর ২০২৪

সমুদ্র উপকূলে হোটেল ভাঙার নির্দেশ ঘিরে সংঘাত। পরিবেশ আদালত এমনটা চাইলেও রাজ্য সরকার গররাজি। হোটেল মালিকরা মামলা করেছেন আদালতে।

https://p.dw.com/p/4nFdu
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, মন্দারমণিতে বুলডোজার চলবে না। ছবি: Prabhakar Mani Tewari/DW

সমুদ্রের উপকূল থেকে ভূমির দিকে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আইনে। কিন্তু সেই আইন অমান্য করে পূর্ব মেদিনীপুরের মন্দারমণিতে অজস্র হোটেল গড়ে উঠেছে। বিতর্ক এই নির্মাণকে কেন্দ্র করে।

‘মন্দারমনিতে সিআরজেড সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছ’

সাগরপাড়ে নির্মাণ

সমুদ্র তীরে নির্মাণের বিরুদ্ধে মামলা হয়  জাতীয় পরিবেশ আদালতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে ওই আদালত ওয়েস্ট বেঙ্গল কোস্টাল রেগুলেশন জোন অথরিটিকে সব বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দেয়। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটির চেয়ারম্যান বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দেন। জেলাশাসকের নির্দেশ, ২০ নভেম্বরের মধ্যে প্রায় ১৪৪টি হোটেল, রিসর্ট, লজ, হোম স্টে ভাঙতে হবে। নইলে কড়া আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। 

এই নির্দেশের ফলে হইচই পড়ে গিয়েছে। জেলা প্রশাসনের নির্দেশের বিরোধিতা করেছে খোদ রাজ্য সরকার। মঙ্গলবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "কোনো বুলডোজার চলবে না বাংলায় ৷ মুখ্যসচিবের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শ ছাড়াই এই নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন৷"

মন্দারমণি এলাকায় গড়ে ওঠা এই হোটেল ব্যবসা জমে উঠেছে। এর মাধ্যমে কয়েক হাজার মানুষের রুটি-রুজির সংস্থান হয়। ফলে সেগুলি ভাঙা হলে অনেকে বেকার হয়ে যাবেন। সেই সঙ্গে পর্যটন ব্যবসা  ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন সওয়াল করছেন হোটেল মালিকরা। তারা কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছেন। তাদের বক্তব্য,  নির্মাণগুলি আদৌ বেআইনি নয়। জেলা প্রশাসনের অনুমোদন নিয়েই তা তৈরি হয়।

মন্দারমণি হোটেল অ্যাসোসিয়েশন এর সম্পাদক অশোক আদক বলেন, "হোটেল, লজ, হোমস্টেগুলো ভেঙে দিলে পুরো এলাকার অর্থনীতিটা শেষ হয়ে যাবে! নিত্যদিন প্রায় এক লাখের বেশি মানুষজন এখানে রোজগার করে খাচ্ছেন! মন্দারমণি মানচিত্র থেকে মুছে যাবে! তিলতিল করে টাকা রোজগার করে এইসব বানিয়েছি আমরা। আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।"

উত্তরপ্রদেশ-সহ বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্মাণ ভাঙতে বুলডোজার চালানো হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। সেই প্রসঙ্গ টেনেই মমতা মন্দারমণির হোটেল ভাঙার নির্দেশের বিরোধিতা করেছেন। নবান্নকে অন্ধকারে রেখে কেন জেলা প্রশাসন পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, "এই কাজটা করেছে সিপিএম৷ এর জন্য ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আইন মেনে যদি এই ১৪৪টি হোটেল ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে শুধু হোটেল ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, কর্মহীন হবেন সেখানে কাজ করা কর্মচারীরা।"

পরিবেশকর্মীদের ক্ষোভ

পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী থেকে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, আইনবিরুদ্ধ কাজ করে এখন কর্মসংস্থানের দোহাই দিচ্ছে রাজ্য সরকার।

সমুদ্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তুহিন ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "মন্দারমণিতে যে ঘটনা নিয়ে এখন হইচই হচ্ছে, তা দীর্ঘদিন ধরে হয়েছে এবং প্রশাসনের সামনে হয়েছে। আমাদের কোস্টাল রেগুলেশন জোনের (সিআরজেড) প্রথম ১০০ মিটার 'নো কনস্ট্রাকশন জোন' বলে বিবেচিত হয়। তারপর কিছু বিধিনিষেধ, কিছু ছাড় রয়েছে যেটা দিয়ে কনস্ট্রাকশন করা যায়। কিন্তু মন্দারমনিতে সিআরজেড সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।"

তাঁর বক্তব্য, "আগে মন্দারমণি টুরিস্ট স্পট ছিল না। জলদাঘটি বা ওই ধরনের মাছের আড়ত ছিল। সেই জায়গাগুলো ২০-২৫ বছর ধরে বিধিনিষেধ না মেনে বেপরোয়া ভাবে ক্রমশ রূপান্তরিত হল ট্যুরিজম সেক্টরে। দীর্ঘদিন ধরে এই অব্যবস্থা দেখে কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হয়নি! আজ যখন পরিবেশ আদালত এগুলোকে বেআইনি বলছে, তখন যদি বেআইনি কাজ ভেঙে দেয়ার বিরোধিতা আসে, তাহলে তো মনে হচ্ছে বেপরোয়া বেআইনি কাজকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। এটা পরিবেশের পক্ষে ও আগামী দিনের প্রজন্মের জন্য খুবই বিপজ্জনক। সমুদ্রের জোয়ার ভাটার খেলা নিয়ন্ত্রিত করার জন্য খুবই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে।"

তুহিন মনে করেন, "সমুদ্রের তলের উচ্চতা বৃদ্ধি হচ্ছে। যার ফলে ভাঙন বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে এই সমস্ত নির্মাণ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবে। তার আগে যারা ওখানে ইনভেস্ট করেছেন, তারা হয়তো তাদের লাভ তুলে নেবেন। কিন্তু সমুদ্র আরো বেশি ভয়াল হয়ে যাবে, সমুদ্র সৈকতগুলো চিরতরে জন্য হারিয়ে যাবে।"

দীর্ঘদিনের পরিবেশকর্মী নব দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "তদন্ত করেছে কারা? পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড, ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে নির্মাণগুলো অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে, তারা যা বর্জ্য নিষ্কাশন করছে, সেটাও সরাসরি সমুদ্র গিয়ে মিশছে। এ সমস্ত তথ্যই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এবং এই তদন্তের উপর নির্ভর করেই পরিবেশ আদালত এই নির্দেশ দিয়েছে।"

তিনি বলেন, "নির্দিষ্টভাবে পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ এবং পরিবেশ দপ্তর, এদের অনুমতি ছাড়া কোনো হোটেল, লজ নির্মাণ করা যায় না ওখানে। সিআরজেড আইন ভঙ্গ করে কোন কিছুই ওখানে গড়ে ওঠার কথা নয়। ভারতবর্ষে সর্বত্রই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। একমাত্র গোয়া ছাড়া সব জায়গাতেই এই ঘটনাগুলি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে দিঘা মন্দারমনি এবং অন্যান্য জায়গায় রাজনৈতিক কারণে  বেআইনি নির্মাণ ছড়িয়ে পড়েছে।"

তিনি বলেন, "পরিবেশ কর্মী হিসেবে আমরা সবসময় বলি, পশ্চিমবঙ্গে এসে পরিবেশের যাবতীয় আইন থমকে যায়। এখানে আইনের শাসন বলে কিছু নেই। এখানে পরিবেশ আইনকে মান্যতা দিয়ে সরকারি এজেন্সিগুলি কাজ করে না। কাজ করতে গেলে তারা বাধা প্রাপ্ত হয়। আজ যেমন ডিসট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।"

নব দত্তের আক্ষেপ, "ভারতবর্ষে পরিবেশ নিয়ে যে কয়টা আইন আছে, তার মধ্যে সিআরজেড সবচেয়ে শক্তিশালী আইন। বহু মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে সেই আইন আমরা পেয়েছি। অথচ সেই পরিবেশ আইন নিয়ে চূড়ান্ত নৈরাজ্য চলছে। কোর্টের আদেশ মানা হয় না। পুরো বিষয়টা এখানে ভোটব্যাঙ্ক। পরিবেশ অপরাধী নিয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নীরব থাকেন।"

তার প্রশ্ন, "সমুদ্র সম্পর্কে কোনো পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। তাই বহু মানুষের মৃত্যু হয় উপকূল অঞ্চলে। সেখানে দাঁড়িয়ে কোস্টাল রেগুলেশন জোন আইন ভঙ্গ করা হচ্ছে, এটা খুব চিন্তার বিষয়। যখন প্রথমে এগুলো বেআইনিভাবে গড়ে উঠল, তখনই ভেঙে ফেলার কথা ছিল। তা হলে আজ মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন উঠছে কেন?"

আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "নিঃসন্দেহে আদালতের আদেশকে মান্যতা দিতেই হবে। যেহেতু এটা পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়, পরিবেশকে রক্ষা করতেই হবে। পরিবেশ আমাদের প্রাথমিক অধিকারের অন্তর্গত। তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরনের বক্তব্যগুলো অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং প্রকৃতপক্ষে নৈরাজ্যকেই প্রশ্রয় দেবে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷