আদম ব্যবসায়ী শিকার শুরু
১৯ মে ২০১৫লিবিয়ায় আদম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতির আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একেবারে নতুন এক ক্ষেত্রে পা রাখলো৷ অতীতে ইউরোপীয়রা কখনো এমন বিপজ্জনক সামরিক অ্যাডভেঞ্চারের সাহস দেখায় নি৷ তাও আবার এমন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, যাদের ধরা এবং যাদের মতিগতি বোঝা কঠিন৷ মনে রাখতে হবে, যুদ্ধে যেমন প্রতিপক্ষ থাকে, আদম ব্যবসায়ীরা মোটেই সে রকম নয়৷ তারা কোনো সেনাবাহিনী নয়৷ তারা এমন এক অপরাধী চক্র, যাদের সম্ভবত লিবিয়ায় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত মিলিশিয়া বাহিনী এবং ইউরোপে মাফিয়ার সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে৷ ইইউ যখন আদম ব্যবসায়ীদের নৌকা ও সম্পত্তি ধ্বংস করতে শুরু করবে, তখন তারাও পালটা হামলা চালাবে – এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ অথবা তারা হয়তো শরণার্থীদের জিম্মি করে ‘মানবিক ঢাল' হিসেবে ব্যবহার করতে পারে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামরিক নেতৃত্বকে এই অভিযানের নিয়মকানুন সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে, যাতে সমুদ্রের মাঝে অথবা লিবিয়া উপকূলে কোনো বিপর্যয় না ঘটে৷ পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা যে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার খুঁটিনাটি বিষয়গুলির নিষ্পত্তি করতে অনেক কাজ এখনো বাকি রয়েছে৷ জার্মানির উন্নয়ন সাহায্য মন্ত্রী গ্যার্ড ম্যুলার ঠিকই বলেছেন৷ তাঁর মতে, সামরিক অভিযানের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না৷ শরণার্থীরা আগের মতোই ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাবে৷ যতদিন না আইনি পথে ইউরোপে অভিবাসনের পথ খুলে যাবে, ততদিন তারা অন্য পথ খুঁজবে এবং অপরাধী আদম ব্যবসায়ীদের শরণাপন্ন হবে৷
আপদকালীন পদক্ষেপ
হিংসাত্মক পদক্ষেপের মাধ্যমে লিবিয়ায় আদম ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপ হয়তো সাময়িকভাবে দমন করা সম্ভব হবে৷ কিন্তু তাদের ব্যবসায়িক মডেল তখনই পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হবে, যখন শরণার্থীরা আইনি পথে ইউরোপে প্রবেশ করতে পারবে৷ কারণ তখন আদম ব্যবসায়ীদের চাহিদা আর থাকবে না৷ আইনি পথে ইউরোপে শরণার্থীদের প্রবেশ তখনই সম্ভব হবে, যখন ইইউ এক সাধারণ অভিবাসন নীতি এবং শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ও অর্থনৈতিক অভিবাসনে আগ্রহীদের ‘সুষম' বণ্টনের বিষয়ে একমত হতে পারবে৷ কিন্তু রণতরি ও বোমারু বিমান পাঠানোর তুলনায় এ বিষয়ে ঐকমত্য আরও অনেক কঠিন বিষয়৷ ইইউ-র অনেক সদস্য রাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই একেবারে প্রস্তুত নয়৷
ইইউ কীভাবে শরণার্থীদের উৎসস্থল – অর্থাৎ আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে সমস্যার মূলে আঘাত করবে, সেটাও একেবারে স্পষ্ট নয়৷ বহু বছর ধরে এমন উদ্দেশ্যের কথা বলা হচ্ছে৷ কিন্তু বাস্তবে তা খুবই কঠিন বিষয় হয়ে রয়েছে৷ যেসব দেশ থেকে মানুষ পালিয়ে শরণার্থী হচ্ছে, তাদের দায়িত্বও ইইউ-র চেয়ে কম নয়৷
এই মুহূর্তে ইইউ শরণার্থী সংকটের লক্ষণ দূর করার চেষ্টায় লিপ্ত৷ সমুদ্রের বুকে শরণার্থীদের উদ্ধারের কাজ অবশ্যই সঠিক ও মানবিক৷ কিন্তু সেটা নিয়মিত অবস্থা হতে পারে না৷ লিবিয়ায় আদম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানও বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে ছোট ও সাময়িক পদক্ষেপ হতে পারে৷
অমীমাংসিত প্রশ্ন
ইউরোপীয় সীমান্তরক্ষী সংস্থা ‘ফ্রন্টেক্স'-এর সূত্র অনুযায়ী শরণার্থীরা ইতিমধ্যেই অন্য পথ গ্রহণ করতে শুরু করেছে৷ তুরস্ক থেকে পাড়ি দেওয়া নৌকার সংখ্যা বাড়ছে৷ তুরস্ক ও বুলগেরিয়ার স্থলসীমান্তে চাপ বাড়ছে৷ তুরস্কের স্থল অথবা জল সীমানায় সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেওয়া মোটেই সহজ হবে না৷
এই অবস্থায় এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, যে ইইউ মন্ত্রীরা সমুদ্রে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নাগরিকদের সামনে তাঁদের ঐক্য ও প্রত্যয় দেখাতে চেয়েছেন৷ কিন্তু আসল প্রশ্ন তাঁরা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন৷ আর সেই প্রশ্ন হলো – যে সব মানুষ, যে সব শরণার্থী হাজারে-হাজারে লিবিয়ার মতো অরজাকতায় ভরা রাষ্ট্রে ইউরোপে পৌঁছানোর অপেক্ষায় দিন গুনছে, তাদের কী হবে?
এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও মনে রাখতে হবে, যে ইউরোপীয়রা এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি মানবিকতা দেখাচ্ছে৷ এশিয়ায়ও মানুষ জাহাজে করে পালাবার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ সেখানে তাদের দায়িত্ব নিতে কেউ প্রস্তুত নয়৷ তাদের সহায়তা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে৷ এমন দুর্গ গড়ে তোলার মানসিকতা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো দূরে রয়েছে৷ আশা করা যায়, এই মনোভাবের পরিবর্তন হবে না৷