আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ!
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬একশ' বছরের বেশি আগে আলব্যার্ট আইনস্টাইন বলে গেছিলেন মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ থাকার সম্ভাবনার কথা – তাঁর যুগান্তকারী ‘জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি' তত্ত্বের আনুষঙ্গিক হিসেবে৷
সহজ কথায়, পদার্থের অবস্থানের ফলে ‘স্পেস' অর্থাৎ ব্যাপ্তি, এবং ‘টাইম' অর্থাৎ সময় বা কাল যেভাবে বিকৃত হয়, তার পিছনে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের ভূমিকা আন্দাজ করেছিলেন আইনস্টাইন৷ স্পেস-টাইম কনটিনুয়াম, বা ব্যাপ্তি ও কালের যৌথ সত্তাকে একটি জালের মতো করে ভেবেছিলেন আইনস্টাইন; কোনো ভারী পদার্থ – একটা বলের মতো – সেই জালের ওপর পড়লে, জালটা ঝুলে পড়ে বা ঢেউ খায়, অর্থাৎ ব্যাপ্তি ও কাল বেঁকে যায়!
ঘটনাটা কী ঘটেছে
যে কোনো বস্তুর একটা ‘মাস' বা তার অভ্যন্তরীণ পদার্থের পরিমাপ থাকে৷ মাধ্যাকর্ষণ যখন সেই পদার্থকে টানে, তখন ‘মাস' গিয়ে দাঁড়ায় ‘ওয়েট' বা ওজনে৷ বস্তুটির আকারের তুলনায় তার ‘মাস' বা পদার্থ যদি অকল্পনীয় রকম বেশি হয়, এত বেশি যে, এমনকি আলোর ফোটনও সেই পদার্থের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ছাড়িয়ে বেরুতে পারবে না – কাজেই সেই বস্তুটি থেকে কোনো আলোকরশ্মি আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছাবে না, ফলে আমরা দেখব – মহাকাশে একটি কালো গর্ত বা ব্ল্যাক হোল৷ আইনস্টাইন সে কল্পনাও করে গেছিলেন৷
এবার দেখা যাক, কী নিয়ে এত চেঁচামেচি৷ আর কিছু নয়, ১৩০ কোটি বছর আগে আমাদের সূর্যের ২৯ গুণ বেশি পদার্থধারী একটি ব্ল্যাক হোল, সূর্যের ৩৬ গুণ বেশি পদার্থধারী একটি ব্ল্যাক হোলের দিকে ঘুরপাক খেয়ে গিয়ে, শেষমেষ দু'টি ব্ল্যাক হোলের ধাক্কা লেগে, দু'টি ব্ল্যাক হোল পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল৷ পৃথিবী থেকে দেখা ব্রহ্মান্ডের দক্ষিণাংশের এই মহাজাগতিক ঘটনার শেষ সেকেন্ডের একটি ভগ্নাংশ ধরা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা ও ওয়াশিংটনে রাখা যন্ত্রে৷
আলোকরশ্মিও ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক বা বৈদ্যুতিক-চৌম্বক তরঙ্গ৷ বলতে কি, মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ আবিষ্কৃত হবার আগে মহাশূন্য থেকে সব খবরাখবরই আমরা পেতাম এই ধরনের ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গের কল্যাণে৷ কিন্তু ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গ তার যাত্রাপথে ব্যাহত হতে পারে, মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের ক্ষেত্রে যা হয় না৷ উভয় তরঙ্গই চলে আলোর গতিতে৷
কোন যন্ত্রে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ ধরা পড়ল
যন্ত্রটির নাম লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্রাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি বা আদ্যক্ষরগুলি মিলিয়ে ‘লিগো'৷ এই লিগো যন্ত্রটি ইংরিজি ‘এল' শব্দের মতো এবং প্রায় চার কিলোমিটার লম্বা৷ সুদূর অতীতে দুই ব্ল্যাক হোলের মধ্যে সংঘর্ষ থেকে ভেসে আসা মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ লুইজিয়ানা আর ওয়াশিংটনের লিগোতে পৌঁছায় ২০১৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৬৫১ জিএমটি-তে৷ সেই তথ্য সতীর্থদের সঙ্গে যাচাই করে প্রকাশ করতে করতে এতদিন সময় লেগে গেছে৷ তথ্যকে শব্দতরঙ্গে রূপান্তরিত করে বিজ্ঞানীরা যা শুনেছেন, তা যেন বাস গিটারের সবচেয়ে নীচু স্বর থেকে শুরু করে পিয়ানোর মিডল সি পর্যন্ত – যেন দূরে মেঘের ডাকের মাঝে মাঝে একটি ছোট্ট পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে!
এই আবিষ্কারের তাৎপর্য
‘‘জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটা নতুন সরঞ্জাম পাওয়া গেল'', বলেছেন এমআইটি-র অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট নার্গিস মাভালভালা৷ ‘‘যেন আমাদের একটা নতুন ইন্দ্রিয় গজিয়েছে৷ এতদিন শুধু দেখতে পেতাম; এবার শুনতেও পারব৷'' কাজেই ব্ল্যাক হোল অথবা নিউট্রন স্টার সম্পর্কে আরো জানবার একটা পন্থা হলো৷ বেতার তরঙ্গ, আলোকরশ্মি, অবলোহিত আলো, এক্স-রে, গামা রে, এ সব ছাড়িয়ে মহাজগৎ-কে জানার আর একটা উপায় হলো আমাদের৷
আইনস্টাইন শুনলে বলতেন, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম৷'
এসি/ডিজি (রয়টার্স, এএফপি)