‘অল্টারনেটিভ নোবেল’ পেলেন পরিবেশবাদী বাসেই
১৭ ডিসেম্বর ২০১০বাংলাদেশের ফুলবাড়ী আন্দোলনের কথা নিশ্চয় সবার মনে আছে! উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে না দেবার আন্দোলন ছিল সেটি৷ কয়লা তুলতে বিদেশি কোম্পানির দেয়া প্রস্তাব এলাকার মানুষের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে সেটা বোঝাতে পেরেছিল তেল, গ্যাস, বন্দর রক্ষা কমিটি৷ ফলে গড়ে উঠেছিল দুর্বার আন্দোলন৷ তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ৷
ঠিক এ ধরণের কাজই করেন নিম্মো বাসেই৷ তেল সমৃদ্ধ নাইজিরিয়ায় বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার বাসেই৷ তবে শুধু তেল নয় জিএম খাদ্য, বায়োফুয়েল এসবের ব্যাপারেও আপত্তি রয়েছে তাঁর৷ আর এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বাসেইকে দেয়া হয়েছে এবছরের ‘অল্টারনেটিভ নোবেল' পুরস্কার৷ তবে একা নন৷ সঙ্গে আছেন ব্রাজিলের এক বিশপ এরভিনন ক্রয়েটলার৷ আদিবাসী মানুষের পরিবেশগত অধিকার রক্ষা ও ধ্বংসের হাত থেকে আমাজন রেইন ফরেস্ট বাঁচানো- এই হলো তাঁর কাজ৷
বাসেই আর ক্রয়েটলারের সঙ্গে রয়েছে ইসরায়েলের ডাক্তারদের একটি সংগঠন ও নেপালের একটি কমিউনিটি অর্গানাইজেশন৷ ‘অল্টারনেটিভ নোবেল' বিজয়ীর জন্য যে দুই লক্ষ ইউরো বরাদ্দ রয়েছে সেগুলো এই চার ব্যক্তি ও সংস্থার কাছে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হয়েছে৷
‘অল্টারনেটিভ নোবেল' সম্পর্কে কিছু তথ্য
১৯৮০ সাল থেকে জার্মান-সুইডিশ সাংবাদিক ও ডাকটিকিট সংগ্রাহক ইয়াকব ফন উয়েক্সকুল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাইট লাইভলিহুড ফাউন্ডেশন ৫০ হাজার ইউরোর বিকল্প নোবেল পুরস্কার দিয়ে আসছে৷ ফাউন্ডেশন পুরস্কৃত করে সেই সব ব্যক্তি বা সংস্থাকে যারা কিনা পরিবেশ ধ্বংস করার বিরুদ্ধে কাজ করছেন - সক্রিয় হয়েছেন অনুন্নয়ন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে৷ মানবজাতির সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার যে অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই ইয়াকব ফন উয়েক্সকুল বিকল্প নোবেল দেয়ার কথা চিন্তা করেন৷ প্রথমে তিনি অবশ্য নোবেল কমিটিকেই পরিবেশ রক্ষার জন্য পৃথক এক পুরস্কার চালু করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ দিতে চেয়েছিলেন তার জন্য অর্থ৷ কিন্তু কমিটি সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে৷ তিনি বলেন, ‘‘পরিবেশ রক্ষার জন্য পুরস্কার নয় কেন? আজকের দিনে আমাদের প্রকৃতিদত্ত পরিবেশ রক্ষাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তাই না? আমি তো সুইডেনে বড় হয়েছি৷ তাই জানতাম যে নোবেল পুরস্কার কেউ পেলে তাকে সারা দুনিয়ায় খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়৷ এই ভাবনা থেকেই নোবেল কমিটির কাছে আমি পুরস্কারের জন্য অর্থ দিতে চেয়েছিলাম৷ বিক্রি করে দিয়েছিলাম আমার সংগ্রহের সব ডাকটিকিট৷''
নাইজিরিয়ার বাসেই-এর কাহিনী
বাসেই'এর মতে, নাইজার উপত্যাকাতে প্রতিবছর ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০টি মতো ‘স্পিলিং' এর ঘটনা ঘটে৷ সাগর বুকে তেল ছড়িয়ে পড়াকে স্পিলিং বলে৷ এইতো কয়েকদিন আগে যেমনটা হয়েছিল মেক্সিকো উপসাগরে৷ সেসময় বিপি কোম্পানির একটি তেলের রিগে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছিল৷ ঘটনাটা যুক্তরাষ্ট্রে হওয়ায় বেশ হৈচৈ বেঁধে যায়৷ মেক্সিকো উপসাগরের দুর্ঘটনার মতো আরেকটি আলোচিত দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত তেল কোম্পানি ‘এক্সন' এর ট্যাঙ্কার ‘এক্সন ভাল্ডেজ'৷ কারণ এই তেলের ট্যাঙ্কার ছিদ্র হয়েও বেশ কিছু তেল পড়ে গিয়েছিল সাগরে৷
সাগরে তেল পড়লে সেখানে থাকা মাছ সহ সাগরের নিচের জীব বৈচিত্র্যের ওপর একটা মারাত্মক খারাপ প্রভাব পড়ে৷ শুধু সাগরবক্ষেই নয়, তেল যেতে যেতে উপকূলের দিকে চলে যায়৷ ফলে সাগর তীরবর্তী মানুষের বসবাসে সমস্যা হয়৷ তাঁদের শরীরে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে৷
ধারণা করা হয়, ‘এক্সন ভাল্ডেজ' ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা নাইজার উপত্যাকাতে প্রায় প্রতিবছরই ঘটে থাকে৷ এবং গত ৫০ বছর ধরে এটা হয়ে আসছে৷ নাইজিরিয়ার সরকারেরই এক হিসেবে দেখা গেছে ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে স্পিলিং-এ ঘটনা ঘটেছে ৩২০০-রও বেশি৷ সমস্যার কথা হলো এসব দুর্ঘটনার পর সবগুলোর ক্ষেত্রে পরিস্কার করার কাজটি করা যায়নি৷ ফলে নাইজার উপত্যাকার অবস্থা কেমন সেটা সহজেই বোঝা যাচ্ছে৷ তাইতো ঐ উপত্যাকার মানুষের জীবনের গড় আয়ু মাত্র ৪১ বছর৷
বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো এসব স্পিলিং এর জন্য নিজেদের দায়ী মনে করেনা৷ তাদের অভিযোগ, তেল চুরি আর সন্ত্রাসী ঘটনা এরজন্য দায়ী৷ কিন্তু অল্টারনেটিভ নোবেল জয়ী বাসেই'এর অভিযোগ, পুরনো পাইপ ব্যবহার আর নিরাপত্তা বিধি ঠিকমত না মেনে চলার কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ এছাড়া কোনো ঘটনা ঘটার পর সেটা ঠিক করার ক্ষেত্রেও বিদেশি কোম্পানিগুলো ত্বরিৎ ব্যবস্থা নেয়না বলে অভিযোগ বাসেই'এর৷
এভাবে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে জনগণকে, সরকারকে তথা বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন বাসেই৷
প্রতিবেদন: জাহিদুল হক
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক