অযোধ্যায় ভূমিপুজো, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন তবু থেকেই গেল
৫ আগস্ট ২০২০আধঘণ্টার মতো অনুষ্ঠান। যে জায়গায় একসময় বাবরি মসজিদ ছিল এবং যা ১৯৯২ সালে ধুলিসাৎ করে দেওয়া হয়, সেখানেই প্রস্তাবিত রামমন্দিরের গর্ভগৃহে রুপোর ইট প্রতিষ্ঠা করে, ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামমন্দির তৈরির সূচনা করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গর্ভগৃহ মানে মন্দিরের কেন্দ্রস্থল এবং যেখানে রামের জন্ম হয়েছিল বলে বিশ্বাস। সেখানেই পরে শ্রীরামের মূর্তি বসবে। করোনাকালেএই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তাই মোদী সহ সকলের মুখেই ছিল মাস্ক। সেই সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাঁরা বসেছিলেন। প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে মোদী এবং অন্যদের যথেষ্ট দূরত্ব ছিল। বারাণসীর পুরোহিতরা মন্ত্রোচ্চারণ করলেন, পুজো হলো। সেই পুজো হলো মোদীর নামেই।
তার আগে মোদী অযোধ্যা পৌঁছে প্রথমে হনুমানগড়ির মন্দিরে বজরঙ্গবলী হনুমানের পুজো করেন। তারপর সোজা যান রামলালা দর্শনে। মন্দিরে প্রবেশের আগেই পুরো শুয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন। রামলালার পুজো করে তিনি যান মূল অনুষ্ঠানস্থলে। এ দিন পুরো অনুষ্ঠানই ছিল মোদী-ময়। তাঁর অযোধ্যায় আসা থেকে যার শুরু, রামমন্দিরের ভূমিপুজোর পর বক্তৃতা দিয়ে বিদায় পর্যন্ত পুরো সময়টায় প্রধান আকর্ষণ ছিলেন মোদীই। এই প্রথম ধুতিপরিহিত মোদীকে দেখা গেল। তার সঙ্গে ছিল তসরের পাঞ্জাবি ও গেরুয়া স্ট্রাইপড অঙ্গবস্ত্র। ভূমিপুজোর পর মোদী বললেন, রামমন্দির মুক্ত হলো। তুলনা করলেন ১৫ অগাস্টের সঙ্গে।
স্বাধীনতার পর সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের প্রশ্ন যখন উঠেছিল, তখন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের দীর্ঘ পত্রযুদ্ধ হয়েছিল। নেহরু সরকারি টাকায়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির নির্মাণের বিরোধী ছিলেন। তাঁর মত ছিল, ধর্মীয় বিষয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়। রাজেন্দ্রপ্রসাদের চাপে শেষ পর্যন্ত অবশ্য নেহরু পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিলেন। মোদী অবশ্য নেহরুর মত মানেন না। তিনি দেশে-বিদেশে মন্দির দর্শন করেন। পুজো দেন। অযোধ্যার অনুষ্ঠান মোদীময় হওয়া নিয়েও তাই আশ্চর্যের কিছু নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং স্বরাজ্য পার্টির নেতা যোগেন্দ্র যাদবের মতে, ''একজন রাজনীতিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছেন তা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সু-নীতি হতে পারে না। কিন্তু বর্তমান ভারতে এতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।''
যেখানে ভূমিপুজো হলো, সেই জায়গায় পুরোহিতরা ছাড়া ছিলেন মাত্র পাঁচজন। প্রধানমন্ত্রী মোদী, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যপাল আনন্দীবেন প্যাটেল, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত এবং রামজন্মভূমি ট্রাস্টের প্রধান নৃত্যগোপাল দাস। অর্থাৎ, ভূমিপুজোর অনুষ্ঠানটা যে বিজেপি-আরএসএস নিয়ন্ত্রিত তা পরিষ্কার। কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা, বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীকে সেখানে দেখা যায়নি।
করোনাকালেরামমন্দিরের ভূমিপুজোর সিদ্ধান্ত জানার পরেই সোচ্চার হয়েছিলেন প্রবীণ রাজনীতিক শরদ পাওয়ার। তিনি বলেছিলেন, এখন তো করোনার মোকাবিলা করাই প্রথম কাজ। মন্দিরের কাজ তো পরেও শুরু করা যায়। কিন্তু তাঁর সেই কথায় কেউ কান দেননি। এরপরই অভিযোগ উঠেছে, করোনার মধ্যে এখনই ভূমিপুজো করার একটা রাজনৈতিক কারণও আছে। মন্দির শেষ করতে সাড়ে তিন বছর সময় লাগবে। তখনই পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন। ফলে ২০২৪ সালের নির্বাচন রামকে সামনে রেখে লড়বেন মোদী। প্রচারেও আসবে, মোদী থাকলে যে কিছুই অসম্ভব নয়, তা রামমন্দিরের নির্মাণ থেকে আবার প্রমাণিত হলো।
বিরোধীরা বলছেন, এর পাশাপাশি আরেকটা কারণও আছে। তা হলো, ক্রমশ লোকের মনে ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, করোনার মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থ। অর্থনীতিও প্রবল চাপে। বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণ গরিব মানুষ থেকে মধ্যবিত্ত সকলেই প্রতিদিনের জীবন চালাতে সমস্যায় পড়ছেন। যখন করোনা সবে ছড়াচ্ছিল, মাত্র শপাঁচেক লোক আক্রান্ত ছিলেন, তখন চারঘণ্টার নোটিসে লকডাউন ঘোষণা করা হলো। এখন প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি লোক আক্রান্ত, অথচ সব খোলা। লোকে কাজের খোঁজে দিশেহারা। সেই সময়ে লোকের নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে গেলে করোনাকালেও রামমন্দিরের ভূমিপুজো জরুরি ছিল। এই মুহূর্তে ভারতে অন্য সব পিছনে, সব সংবাদমাধ্যম রাম-ময়। আর হবে নাই বা কেন, শোনা গেছে, উত্তর প্রদেশ সরকার তো আগে থেকেই চ্যানেলগুলির কাছ থেকে হলফনামা নিয়েছে, তার নিহিতার্থ হলো, ভিন্ন সুরে কথা বলা যাবে না। কোনোরকম উত্তেজনা দেখা গেলেই চ্যানেলের কর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এ নিয়ে কারো মনে দ্বিধা ছিল না অযোধ্যায় মন্দির হবে। দ্রুত হবে। কিন্তু সেই মন্দির নির্মাণের দিন এই ধরনের বিরোধী স্বরও যে উঠবে, তা ভাবা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘ভারত তার চিরায়ত বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ঐতিহ্যকে বহন করছে। আমাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই ঐতিহ্যকে বজায় রাখবই।'' অধীর চৌধুরি জাতীয় নিরাপত্তা আইনে আটক চিকিৎসক কাফিল খানের মুক্তি দাবি করে বলেছেন, ''অবিচার ও বৈষম্য করে কখনো রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না।'' আর রামের তুমুল প্রশংসা করে রাহুল গান্ধী বলেছেন, ''রাম হলেন প্রেমের প্রতীক, তিনি কখনো ঘৃণার মধ্যে প্রকট হতে পারেন না। রাম করুণার প্রতীক, তিনি কখনো ক্রুরতার মধ্যে প্রকট হতে পারেন না। রাম ন্যায়ের প্রতীক, তিনি কখনো অন্যায়ের মধ্যে প্রকট হতে পারেন না।'' তবে এভাবে রাম রাজনীতি আলোচনায় এসে যাওয়ায় বিজেপিরই সুবিধা হবে বলে মনে করেন বিশেষশজ্ঞদের একাংশ।
আবার যোগেন্দ্র যাদবের কথায় ফিরে আসি। তাঁর মতে, ''এ দিন নরেন্দ্র মোদী, যোগী আদিত্যনাথদের উপস্থিতিতে রামমন্দিরের যে অনুষ্ঠান হলো, তা থেকে পরিষ্কার, সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির জয় হলো। অযেোধ্যায় এ দিনের অনুষ্ঠান হলো পুরোপুরি রাজনৈতিক। এই অনুষ্ঠান হলো বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতার মিশেল। রাষ্ট্রের ক্ষমতা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ক্ষমতা, আধুনিক মিডিয়ার ক্ষমতা এবং ধর্মীয় কর্তৃত্বের ক্ষমতা।'' তাঁর সিদ্ধান্ত হলো, পরাজয় হলো ধর্মনিরপেক্ষতার।