তবুও স্বপ্নময় বাংলাদেশ
১ জানুয়ারি ২০১৪এমন বাংলাদেশ আশা করেননি টগবগে তরুণ ইরফান আহমেদ৷ দু'বছর আগে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন তাঁর চোখে ছিল সত্যিই এক ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ'-এর স্বপ্ন৷ কিন্তু এখন তিনি মনে করেন, উল্টো পথে হাটছে তাঁর দেশ৷ তাঁর স্বপ্নও ফিকে হয়ে এসেছে৷ তাঁর একটিই কথা, ‘‘বাধা না দিলে বাংলাদেশ আপন শক্তিতে এগিয়ে যাবে৷ অথচ যাঁদের এই অগ্রযাত্রায় সহযোগিতা করার কথা, সেই রাজনীতিবিদরাই বাংলাদেশকে পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন৷''
কেন এমন হচ্ছে? জানতে চেয়েছিলাম ঢাকার তরুণ সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নার কাছে৷ তাঁর সাফ জবাব, রাজনীতিবিদরা দেশের কথা ভাবেন না৷ তাঁরা ভাবেন ক্ষমতার কথা৷ রাজনীতি এখন বাংলাদেশে একটি বড় ব্যবসা৷ আর ক্ষমতায় থাকলে কিছু না করে কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জন সম্ভব৷ তাই কেউই ক্ষমতা ছাড়তে চান না৷ দেশের মানুষ তাঁদের কাছে রাজনীতির গিনিপিগ৷
১লা জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না৷ কারণ এই অবরোধের মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দল ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে চায়৷ ওদিকে সরকার কোনোভাবেই এই নির্বাচন থেকে সরে আসবে না৷ তাই যুদ্ধ চলবে দুই রাজনৈতিক জোটের মধ্যে৷ আর তাতে পুড়বে মানুষ, ব্যবসা বন্ধ হবে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পথে বসবেন, রপ্তানিতে ধস নামবে, স্কুল-কলেজ লাটে উঠবে৷
তারপরও চলবে এই ‘গণন্ত্রের লড়াই'৷ বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই৷ তাঁর কথা, সরকারই দেশকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে৷ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে৷ তাই এই সরকারের বিদায় এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া সংকট কাটবে না৷
মজার বিষয়, এর ঠিক বিপরীত কথা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের৷ তিনি বলেন, দেশের এই সংকটে জন্য দায়ী বিরোধী দল৷ তারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্দোলনের নামে দেশজুড়ে সহিংসতা চালাচ্ছে৷ গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করতে চাইছে৷ তারা চাচ্ছে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে৷ কিন্তু নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার আর কোনো পথ নেই৷ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের ট্রেন ‘মিস' করে তারা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে৷
সিপিডি-র অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অল্প সময়ে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সব সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের৷ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সূচক সে কথাই বলে৷ উত্পাদন, রপ্তানি বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রেমিটেন্স – সব কিছুই ইতিবাচক৷ তার সঙ্গে আছে পরিশ্রমী ও মেধাবী তরুণরা৷ আছে তাঁদের নতুন চিন্তা এবং উদ্যোগ৷ নেই শুধু ইতিবাচক রাজনীতি৷ তিনি বলেন, দায় না নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি, সহিংসতার রাজনীতি যদি চলতে থাকে, যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব সম্ভাবনা, সম্ভাবনাই থেকে যাবে৷
বাংলাদেশ নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলিরও চিন্তার কমতি নেই৷ আবারও দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা৷ মঙ্গলবার তিনি ‘অবরুদ্ধ' খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর সহিংসতা বন্ধে এখনই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন৷ এছাড়া, ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট গিবসন সোমবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর, মঙ্গলবার দেখা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে৷ অ্যাজেন্ডা একটাই: সহিংসতা বন্ধ, সংলাপ আর সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন৷
২০১৩ সালের শুরুর দিকে তাজরীন ফ্যাশানস-এ আগুন, তারপর রানা প্লাজা ধস৷ বাংলাদেশকে এক ‘নেগেটিভ ইমেজ'-এর মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়৷ বছর শেষে রানা প্লাজা নিয়ে তাসলিমা আক্তারের ছবি আবারো বিশ্বকে তা মনে করিয়ে দিয়েছে৷ অন্যদিকে, রাজনীতির পেট্রোল বোমা যেন এখন বাংলাদেশের পুরো ইতিবাচক ইমেজটাকে পুড়িয়ে দিতে চাইছে৷ তাই তো, এবারের ‘থার্টি ফার্স্ট'-এ ঘরোয়া আয়োজনের বেশি কিছু করার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পুলিশ৷
তাহলে কি এভাবেই সব কিছু ভেঙে পড়বে? ‘না' – দৃঢ় জবাব ইরফান আর পান্নার৷ তাঁরা বলেন, রানা প্লাজার ছবি তুলে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলা মেধাবী ফটোগ্রাফার তাসলিমা বাংলাদেশেরই একজন৷ শুধু তাসলিমা নয়, দেশে-বিদেশে এরকম অনেক বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে৷ কৃষক আর শ্রমিক তাদের ঘামে অর্থনীতি সচল রাখছে৷ তাই পরিবর্তন আসবেই৷ আসতেই হবে৷ ইরফান আর পান্নার কথায়, কোনো গোষ্ঠীর ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারে না মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পথ দেখাবে৷ বাংলাদেশকে একদিন নিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশে৷