অনলাইনে ঘৃণার চাষবাস
২৬ মার্চ ২০১৮মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আক্রমণ করা হয়েছে– এই খবরের নীচে পাবেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল কেন মারা গেলেন না সেটা নিয়ে আফসোস৷ তাঁর নামে বিষোদগার, গালাগালি৷ নেপালে আমাদের একটি উড়োজাহাজ ক্র্যাশ করেছে, সেটাকে ঘিরে পাবেন নারীরা কেন উড়োজাহাজ চালায়, সেটা নিয়ে নারীদের বিরুদ্ধে গালাগালি, কুৎসিত যৌনরসাত্মক মন্তব্য৷ ক্রিকেট দল কোনো একটি ম্যাচে পরাজিত হয়েছে, সেই দলের ধর্মীয় সংখ্যালঘু খেলোয়াড়টিকে তাঁর ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ– এসব আকছার ঘটছে৷
মনোবিকারগ্রস্ত এই হাজার হাজার মানুষ আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে– এটি ভাবলেই মনটা বিষন্ন হয়ে উঠে৷ অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না৷ এই ভূখণ্ডের মানুষ সবসময়ই সহমর্মী, মমতাময়ী, পরষ্পরের বিপদে-আপদে উড়ে এসে সহায়তা করা মানুষ৷ এদের একটি বড় অংশ কেন হিংসাত্মক হয়ে উঠছে এর কারণ বের করা জরুরি৷
অনেকেই বলার চেষ্টা করেন যে, এই হিংস্র ও কদর্য মন্তব্যকারীদেরকে আইনের আওতায় আনলেই এই বাড়াবাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে৷ আমি খানিক দ্বিমত পোষন করি৷ প্রথম কথা হচ্ছে, এরা সংখ্যায় অগুনতি, এদেরকে আইনের আওতায় আনার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা আইনশৃংখলা বাহিনীর নেই৷ দ্বিতীয়টি আসলে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ৷ আপনি আইনের শক্তিতে এদেরকে হয়তো ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারবেন, কিন্তু এদের মনের যে ঘৃণা, সেটিকে নির্মূল করা হবে না৷ এই সম্মিলিত ঘৃণার একটি প্রকাশ সমাজের উপর রয়েই যাবে৷
তাই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মানসিক বিকৃতির কারণ খুঁজে বের করা এবং সেই কারণগুলো নির্মূল করা৷ আমার মনে হয়, শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই এখন এটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা দিচ্ছে৷ আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকালীন সময়টিও মিডিয়ায় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করেছি৷ সেখানে হোয়াইট সুপ্রিমেসি'র বর্ণবাদ এবং ইমিগ্র্যান্ট মানুষদের প্রতি বিরূপ মনোভাব একটি বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে৷ একই কাণ্ড হয়েছে ইংল্যান্ডে৷ ব্রেক্সিট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অনেক মানুষকে আমি প্রকাশ্যেই ইমিগ্র্যান্টদের প্রতি প্রবল ঘৃণা উগড়ে দিতে দেখেছি৷
আশা করি মনোবিজ্ঞানীরা এর সঠিক কারণ গবেষণা করে বের করবেন৷ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে আমি সাদামাটাভাবে কিছু কারণ ভেবে বের করেছি৷ একটি বড় কারণ হতে পারে মানুষের জীবনযাত্রায় নিয়ত অস্থিরতা৷ মানুষ জীবনের চাপ অত্যধিক করে ফেলেছে৷ প্রতিমুহূর্তে চাহিদা বাড়ছে, প্রতিক্ষণ প্রতিযোগিতা বাড়ছে৷ এই চাপ নেয়ার জন্য আমাদের মানসিক গড়ন প্রস্তুত নয়৷ সুতরাং মন বিদ্রোহ করছে, এই চাপ ও চাহিদার নিয়ত যুদ্ধে পড়ে যাওয়ার কারণে আশেপাশের সবকিছুর বিরুদ্ধেই একটি বিরূপ মানসিকতার জন্ম হচ্ছে৷
বাংলাদেশের মতো দেশে এর ছাপ আরো অনেক বেশি কারণ, এই দেশে আমরা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি৷ সমাজে এক শ্রেণির লোক নানান ছলচাতুরি করে সব দখল করে নিচ্ছে, অন্যদিকে বিশাল একটি গোষ্ঠী পিছিয়ে পড়েছে৷ এরা যথেষ্ট শিক্ষা পায় না, বিনোদন পায় না, সমাজের মূল নেতৃত্বে আসতে পারে না৷ না পারার এই ব্যর্থতার জন্য তারা বাকি সবাইকে দায়ী করছে৷ পিছিয়ে পড়ার কারণে এরা মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে৷ সেই মানসিক পঙ্গুত্বের কারণেই তারা বাকি মানুষদেরকে বিচার করছে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের মতো ক্ষুদ্র মানদণ্ডে৷
মানুষের মব মেন্টালিটি উগরে দেয়ার যে অবারিত দ্বার ইন্টারনেটের মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে, সেই খোলা পথে তাই এরা উগরে দিচ্ছে মনের ভেতর চেপে থাকা সকল ঘৃণা৷ যে নারী তার চাইতে এগিয়ে, সেই নারীকে সে সহজেই সেক্সিস্ট মন্তব্য করতে পারছে, যে মানুষ তার চাইতে বেশি আলোকিত, তাঁকে হত্যা করতে চাইছে৷ মানুষের মনের ঘৃণা বন্ধ করতে হলে এই বৈষম্য কমিয়ে আনার ব্যাপারে সিরিয়াসলি কাজ করা দরকার৷ নৈতিক, উদারমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সবার জন্য নিশ্চিত করা জরুরি৷ সামাজিকভাবে ভালোবাসা ও সহমর্মিতাকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন৷ এটি একদিনের কাজ নয়, কিন্তু এই কাজটি গুরুত্বের সাথে শুরু করার এখনই সময়৷
আমরা যদি মানুষকে মানুষ বানাতে না পারি, তাহলে এই সম্মিলিত ঘৃণা একদিন আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে ঘায়েল করে ফেলবে৷ সভ্যতার পথে পৃথিবী অনেক হাজার বছর হেঁটে এসেছে, এখনই যদি আমরা পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এক পৃথিবী বানাতে না পারি, তাহলে আর কবে পারবো?
লেখকের সাথে আপনি কি একমত? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷