অনভিজাত দর্শকের চোখে অভিজাত ক্রিকেট
২২ নভেম্বর ২০১৯ম্যাচ শুরু হলো ৩ মার্চ, চলল ১৪ মার্চ পর্যন্ত৷ তিনদিন খেলা হয়নি বৃষ্টির কারণে৷ ভাবছেন, কে জয়ী হলো? না, নয়দিনেও ফলাফলের দেখা মেলেনি৷ শেষ দিন ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য দরকার ছিল ৪১ রান৷ কিন্তু সেটি বাকি রেখেই তাদেরকে পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী জাহাজে চাপতে হয়েছিল৷ খেলাটা যে এতদিন গড়াতে পারে সেটি হয়তো তাদের ভাবনাতেও ছিল না৷ দীর্ঘতম টেস্ট ম্যাচটি তাই পরিসংখ্যানের খাতায় ড্র হয়েই থাকলো৷
একটা সময়ে চার থেকে ছয়দিনের টেস্ট যেমন খেলা হতো তেমনি আবার এমন ‘টাইমলেস' বা বাধাধরা সময়বিহীন ম্যাচও চালু ছিল৷ সময়ের বিবর্তনে সেটি এখন পাঁচদিনে রূপ নিয়েছে৷ কিন্তু তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমী, বোদ্ধা, এমনকি খেলোয়াড়রাও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন৷ কীভাবে টেস্টকে আরো আকর্ষণীয় করা যায় তা নিয়ে নানাজন নানা পরামর্শ দিচ্ছেন, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট ক্লাব আর লিগগুলো৷ এর কিছু নিয়ম চালু করেছে সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসিও৷ যেমন, বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে শুরু হওয়া দিবারাত্রি টেস্টটি৷ এরইমধ্যে অনেকগুলো দেশ অবশ্য গোলাপি বলে খেলে ফেলেছে৷ তাতে টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে নতুন একটা আলোচনা শুরু হলেও সেটি কতটা উত্তেজনা ছড়াতে পারছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে৷
ক্রিকেটের আমি বোদ্ধাতো নই-ই, খুব আগ্রহী দর্শকও না৷ নিজের দল আর দেশ যখন খেলে তখনই মূলত খেলা দেখা হয়৷ আগ্রহের ক্রিকেটার যেসব দলে খেলেন সময়-সুযোগ হলে তাদের ম্যাচগুলোও দেখি৷ মাঝে মাঝে অবশ্য ইউটিউবে শৈশবের কিংবা অতীতের গ্রেটদের পুরনো খেলার ক্লিপস দেখতেও ভালো লাগে৷
টেস্ট, ওয়ানডে পেরিয়ে ক্রিকেট এখন টি টোয়েন্টির যুগে৷ দর্শক আগ্রহ আর ব্যবসার বিবেচনায় স্বল্প সংস্করণটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল সেটি বলা চলে৷ তবে টি-টোয়ন্টির চেয়ে এখনো ওয়ানডেটাই বেশি উপভোগ্য মনে হয়৷ টি-টোয়েন্টি ঠিক আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট যেন হয়ে ওঠে না, শৈশবের পাড়ার খেলার মতোই লাগে৷ ভালো-খারাপ বলের কোনো বালাই নেই, চোখ বন্ধ করে কেবল পেটাও৷ সেদিক থেকে ওয়ানডে ক্রিকেটই ভালো৷ ম্যাচ জয়ের জন্য ব্যাটসম্যান, বোলার, ফিল্ডার সবারই ন্যূনতম নৈপুণ্যের দেখা সেখানে মেলে৷ তবে অনেক ক্রিকেটপ্রেমী অবশ্য ওয়ানডেতেও ঠিক সন্তুষ্ট নন৷ তাদের কাছে প্রকৃত ক্রিকেট আসলে টেস্ট৷
ক্রিকেট নাকি ছিল অভিজাতদের খেলা৷ তবে সেটি ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি যে নয় তা বলা বাহুল্য৷ আভিজাত্যটি লুকিয়ে মূলত টেস্ট সংস্করণে৷ তার নমুনা মেলে ম্যাচ যখন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো ভেন্যুতে হয়৷ দৃষ্টিনন্দন গ্যালারিতে গা এলিয়ে দিয়ে সূর্যস্নান করতে করতে, পরিবার সমেত কিংবা প্রিয়জনকে নিয়ে আয়েশ করে ম্যাচ উপভোগ করা৷ আমার মনে টেস্ট ক্রিকেটের ছবিটা অনেকটা তেমনই৷ ধৈর্য্য ধরে, নিবিষ্ট মনে উচ্চাঙ্গসংগীত উপভোগের মতো করে খেলা দেখা৷ জাকির হোসেনের তবলার সাথে চৌরাসিয়ার বাঁশির যেমন, তেমনি ৷ পাঁচদিন বসে বসে সেটি উপভোগের সুযোগ অবশ্য কতজনেরই বা মেলে৷ আজকের দিনে ব্যাটসম্যান আর বোলারের সেই দ্বৈরথই বা কোথায়!
আমার মতো ক্রিকেটের সাধারণ দর্শকদের কাছে দিনশেষে জয়-পরাজয়ের হিসাবটাই গুরুত্বপূর্ণ৷ আর তাতে শেষমেশ যদি একটা টানটান উত্তেজনা তৈরি হয়, তাহলেই বিনিয়োগকৃত সময় কিংবা পয়সা উসুল৷ সেটির দেখা টেস্টে তো কমই মেলে৷ পাঁচদিনের খেলায় শেষে এসে কয়টা ম্যাচইবা সেই আমেজ ছড়াতে পারে৷ তবে ইদানিংকায় কিছু ম্যাচে এমনটা হয়েছেও বটে৷ কিন্তু অমন দুই-একটা উদাহরণের লোভ দেখিয়ে বেশিরভাগ ম্যাচে পাঁচদিন টিভিসেটের সামনে কিংবা স্টেডিয়ামে বসিয়ে রাখা কি আর সম্ভব! তার চেয়ে ভালো স্কোর জেনে সময় সুযোগ করে শেষটুকু দেখা৷
এমনটা যখন ভাবছি, তখন টেস্ট ক্রিকেটের অতীত গল্পগুলো শুনেও কিন্তু মুগ্ধ হই৷ সত্যিকার অর্থে টেস্ট ক্রিকেট তো আসলে জয়-পরাজয়ের হিসাব নয়৷ বোলারদের সাথে ব্যাটসম্যানদের প্রতিটি বলের যে লড়াই সেটিইতো আসল টেস্ট৷ একপ্রান্তে ডেনিস লিলি, অন্য প্রান্তে স্যার ভিভ রিচার্ডস, মাইকেল হোন্ডিং কিংবা কলিন ক্রফট, অন্যদিক সুনিল গাভাস্কার কিংবা টনি গ্রেগ৷ যেই লড়াইয়ে কখনো বোলার, কখনো জয়ী ব্যাটসম্যান৷ তেমন টেস্ট হলে আমার মতো সাধারণ দর্শকও নিশ্চয়ই খেলা দেখবে৷ না হলে বরংচ ইউটিউবে সেই সময়কার ম্যাচের ক্লিপস দেখে নেয়াই ভালো৷ পিঙ্ক বল হোক, কি খেলা চারদিনের হোক তাতে আমি অন্তত সব ছেড়েছুড়ে নিবিষ্ট মনে দিনব্যাপী টেস্ট দেখার পরীক্ষা দিতে রাজি নই৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷