অটোপাসের চাপে বোর্ড চেয়ারম্যানের ‘অসহায় আত্মসমর্পণ’
২১ অক্টোবর ২০২৪দাবি মানতে না পেরে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার৷
এইচএসসিতে ফেল করাদের অটোপাশের দাবিতে রবিবার শিক্ষাবোর্ড ঘেরাও, ভাঙচুর এবং চেয়াম্যানকে সাত ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখার প্রতিক্রিয়ায় তিনি নিজেকে বোর্ড থেকে প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন।
বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন," যারা পরীক্ষায় ফেল করেছে, তারা অটোপাস চায়। আমার পক্ষে অটোপাস দেয়া সম্ভব নয়। তারা চায়, সব সাবজেক্টে এসএসসির ম্যাপিং করে এইচএসসির ফল। পরীক্ষা না দিয়ে এভাবে পাস করানো যায় না। আমি এটা করতে পারবো না। তাই আমি বোর্ড চেয়ারম্যানের পদ থেকে প্রত্যাহার চেয়ে প্রত্যাহার পত্র দিয়েছি। এখন তারা সিদ্ধান্ত দেবে। আমি কোনোভাবেই অটোপাস দেয়ার বিনিময়ে এই পদে থাকতে চাই না।”
তিনি জানান, "ওই শিক্ষার্থীরা খালি বোর্ড ঘেরাও করেনি, তারা ভাঙচুর করেছে। আমাকে সাত ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এভাবে অটোপাস দিলে তো শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না, তলানিতে চলে যাবে।”
তবে শিক্ষার্থীদের প্রকারান্তরে অটোপাস দাবি এবং দাবি পূরণে অপারগতা প্রকাশ করে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ঘোষণা প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য এখনো জানা যায়নি। আন্দোলকারী এক পরীক্ষার্থী মো. মেহবুব হোসেন জানান, তারা সোমবার শিক্ষা সচিবের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে দেখা করেছেন। তাদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। মো. মেহবুব হোসেনের আরো দাবি, রবিববার তাদের ওপর হামলা হয়েছে। তারও বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তার কথা, “ঢাকা বোর্ড ছাড়া অন্য বোর্ডে মাত্র দুই-তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে। তাদের মূলত প্রায় সব সবজেক্টেই ম্যাপিং করে ফল দেয়া হয়েছে। আমাদের সাত বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে। বাকিগুলো ম্যাপিং করা হয়েছে। ফলে আমাদের ফল খারাপ হয়েছে। আমরা বৈষম্যের শিকার হয়েছি। তাই সব সাবজেক্টেই ম্যাপিং করে রেজাল্ট দাবি করছি।”
তবে এর আগে গত ২০ আগস্ট এই পরীক্ষার্থীরাই আন্দোলন করে, সচিবালয়ে ঢুকে ঘেরাও করে ছয় বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল করিয়েছিল। তখন অনেকে পুরো পরীক্ষা দিতে চাইলেও তাদের দাবি আমলে নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এবার তারা রবিবার দুপুরের দিকে ‘এইচএসসি ব্যাচ ২০২৪'-এর ব্যানারে মিছিল নিয়ে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে যান। তাদের মধ্যে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কৃতকার্য শিক্ষার্থীরাও ছিলেন যাদের ফল আশানুরূপ ভালো হয়নি।
এক পর্যায়ে তারা ফটকের তালা ভেঙে শিক্ষাবোর্ড প্রাঙ্গণের ভেতরে ঢুকে পড়েন। পরে তারা ভবনের ভেতরেও ঢুকে পড়েন । শিক্ষার্থীরা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কক্ষে ও কক্ষের সামনেও ভাঙচুর চালায়। তারা বোর্ড চেয়ারম্যানকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এই ঘটনায় চকবাজার থানায় অজ্ঞাত ৪০-৫০ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে।
অটোপাসের এই দাবি কেন আসছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান বলেন,“ শুরু থেকেই বিষয়টি ঠিকমতো হ্যান্ডেল করা হয়নি। এর আগে ছাত্ররা ছয়টি পরীক্ষা বাতিল করে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল দাবি করলো আর কর্তৃপক্ষ মেনে নিলো। এটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। অনেকেই তো পরীক্ষা দিতে চেয়েছিল। তাদের দাবি মানা হলো না কেন?”
তার কথা," পরীক্ষা নেয়ার নানা উপায় ছিল। যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হয়েছেন, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা যেতো। আর যারা পরীক্ষা দেয়ার মতো অবস্থায় ছিল তাদের পরীক্ষা নেয়া যেতো । প্রয়োজনে দুই মাস পরে পরীক্ষা নেয়া যেতো। কিন্তু এই যে পরীক্ষা না নিয়ে রেজাল্ট তাতে তো শিক্ষার অধঃপতন ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না।”
তার কথা, “প্রথমে আগস্টে যখন পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা না দেয়ার জন্য সচিবালয় ঘোরাও করলো তখনই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। সেটা না করে তাদের প্রশ্রয় দেয়া হলো। এখন তারা পুরাই অটোপাস চাইছে। তাদের সঙ্গে আবার সচিব বৈঠক করছেন। এভাবে চললে শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ পরিণতি হবে। আমরা আশা করেছিলাম শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার হবে। এখন দেখছি শিক্ষাই থাকছে না।”
আর শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন,“ ছাত্ররা দেখছে তারা যে দাবি নিয়ে যায় তাই পুরণ হয়। ফলে তারা এখন অটোপাসের দাবি করছে। এরপর হয়তো স্থায়ীভাবে পরীক্ষা ছাড়াই পাসের দাবি করবে। কিন্তু পরীক্ষা না থাকলে তো ছাত্ররা পড়াশুনা করে না। এটা তারা না বুঝলে আমাদের দায়ত্বি তাদের বোঝানো। কিন্তু আমরা সেটা না করে তারা যা দাবি করছে তাই মানছি। তারাই যদি এভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা চালায় তাহলে তো আর শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না।”
"এরই মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও অটোপাসের দাবি উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে এই দাবি আরো বাড়বে। তাই এখনই এগুলো বন্ধ করা দরকার,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “ভাঙচুর আর ঘেরাও করলেই যদি ছাত্রদের দাবি মেনে নেয়া হয় তাহলে তো ছাত্ররা পড়াশুনা বাদ দিয়ে ভাঙচুর করবে। এর পরিণতি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ছাত্রদের তো বয়স কম। তারা অনেক কিছু বোঝে না। কিন্তু যাদের বোঝানোর দায়িত্ব তারা কেন বোঝচ্ছেন না?”
"এভাবে যদি পরীক্ষা না দিয়ে সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষা চালু হয় তাহলে এই জাতির কপালে দুঃখ আছে,” বলেন তিনি।
একজন অভিভাবক আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন,“ আমার ছেলে নটরডেম কলেজ থেকে এবার পাশ করেছে। সে সব পরীক্ষা দেয়ার পক্ষে ছিল। তারা পরীক্ষা দেয়ার জন্য আন্দোলন করেছিল। তারা যেহেতু ভাঙচুর করেনি তাই তাদের দাবি মানা হয়নি। যারা ভাঙচুর করেছে তাদের দাবি মেনে ছয়টি পরীক্ষা বাতিল করা হলো। তাহলে কি মেধাবীদের এখন আর কোনো জায়গা নাই?”
প্রসঙ্গত, এবার এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হয়েছে পরীক্ষা ও বিষয় ম্যাপিং মিলিয়ে। কারণ, ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি। ওই ছয় বিষয়ে এসএসসির ফলের ম্যাপিং করা হয়েছে। তাতে পাসের হার কমলেও জিপিএ-৫ বেড়েছে। আর বেড়েছে শূন্য(০) পাসের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। পরীক্ষার্থীদের কেউ পাস করেননি এমন সাধারণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গত বছর ছিল ৪১টি। এবার হয়েছে ৬৫টি।
এবার সাধারণ ৯টিসহ এইচএসসি ও সমমানের ১১ টি-বোর্ডের পরীক্ষায় সারা দেশে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। ২০২৩ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৯২ হাজার ৩৬৫ জন শিক্ষার্থী। সে হিসেবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ হাজার ৫৪৬ জন, যা শতকরা হিসাবে ৬৩.৩০ শতাংশ প্রায়।
১১টি শিক্ষা বোর্ডে মোট পরীক্ষা দিয়েছেন ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন। মোট উত্তীর্ণ হয়েছেন ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ জন। পাসের হার ৭৭.৭৮ শতাংশ।