1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

৩১ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতির রেকর্ড

৫ জুলাই ২০২২

রপ্তানি প্রথমবার এক অর্থবছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর সুসংবাদ বিপুল আমদানির তথ্যে ম্লান; কেননা বাড়তে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি মে শেষে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ৷

https://p.dw.com/p/4DfOP
ছবি: Xie Zhengyi/dpa/picture alliance

অর্থবছর শেষে রপ্তানি আয়ের প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ হলেও জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত পুরো বছরের আমদানির তথ্য এখনও আসেনি৷ সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক মে পর্যন্ত আমদানি ব্যয়ের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে৷

এতে দেখা গেছে মে পর্যন্ত অর্থবছরের ১১ মাসে রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় এবং রেমিটেন্সে নেতিবাচক ধারা বজায় থাকায় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার৷  আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঘাটতি বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ (১০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার) ৷ আগের অর্থবছরের আলোচিত সময়ে যা ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার৷

এর প্রভাবে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতিও ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার পার করেছে, যেটিও ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি৷ এক মাস আগেও এপ্রিল শেষে যা ছিল ১৫ দশামিক ৪২ বিলিয়ন ডলার৷

আর গত বছরের মে থেকে এক বছরের ব্যবধানে চলতি হিসাবের এ ঘাটতি ৬ গুণের বেশি বেড়েছে৷ ২০২০-২১ অর্থবছরের মে মাসে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার৷

এমন এক সময়ে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসেবে ভারসাম্যের এ তথ্য প্রকাশিত হল যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ৷ আমদানি ব্যয়ের চাপ মেটাতে গিয়ে ডলারের দাম বাড়ছে, ক্রমাগত মান হারাচ্ছে টাকা৷  নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যায় দুর্দশায় পড়েছে লাখো মানুষ৷

বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে মূলত আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া৷ সে তুলনায় রপ্তানি বাড়েনি যদিও আগের চেয়ে বেড়েছে এবার৷ কিন্তু বৈশ্বিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার বিনিময় হার বেড়ে গেছে৷ একারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়েছে টাকার অঙ্কেও৷

‘‘অপরদিকে রেমিটেন্স সেভাবে এবার বাড়েনি, যদিও গতবার বেড়েছিল৷’’   আমদানি ব্যয় কমিয়ে এনে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে নেওয়া একাধিক পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে বিদেশ ভ্রমণে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, ৭৫% শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন আরোপ করা হয়েছে বিলাসীপণ্য আমদানি নিরুৎসাহ করতে৷’’  

গত এপ্রিলে নেওয়া এসব সিদ্ধান্তের তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি পরের মে মাস শেষেও৷ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব সিদ্ধান্তের প্রভাব জানতে মাস তিনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়৷

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে বাণিজ্য ঘাটতি এ পর্যায়ে যাবে তা আগেই অনুমান করেছিলেন৷

তিনি বলেন, ‘‘ঘাটতি কমিয়ে আনতে ডিমান্ড কাট (চাহিদা কমিয়ে আনতে হবে) করতে হবে প্রথমেই৷ সরকার ইতোমধ্যে কিছু নীতি গ্রহণ করেছে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে, যেমন নতুন গাড়ি ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে৷ এরকম কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ৪০ হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হতে পারে৷’’  

সরকারি পর্যায় আরও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘কিছু পণ্যের যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে৷ দাম বাড়লে মানুষ সচেতন হয়ে ব্যবহার তথা চাহিদা কমাবে৷

Bangladesch Textilfabrik Dhaka
ছবি: Reuters/A. Biraj

‘‘দ্বিতীয়ত বিনিময় হার আরও বাড়ার সুযোগ দিতে হবে৷ তাহলে একটি পর্যায়ে টাকা স্থিতিশীল হবে৷ এতে রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে, যেটা এবার হয়েছে৷’’  

পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, চাহিদা যদি কমিয়ে আনা যায় তাহলে আমদানি কমে যাবে কিছুটা তাতে বাণিজ্য ঘাটতিও কমে যাবে৷

তবে মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য আবশ্যকীয় যেমন চাল-গমসহ খাদ্যপণ্যের যথেষ্ট সরবরাহ রাখতে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি৷

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সরকার চার লাখ টন চাল আমদানির বিশেষ সুযোগ দিয়েছে৷ এতে হবে না ২০ লাখ টন সাপোর্ট লাগবে৷ তাহলে দাম সমন্বয় হবে৷ এরকম আরো কিছু পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে৷

‘‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেশি জরুরি৷ এতে জিডিপি গ্রোথ একটু সমন্বয় হলেও তো ক্ষতি নেই৷ সরকার ইতোমধ্যে সেই দিকেই হাঁটছে৷ বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে৷ ’’  

রেকর্ড ঘাটতি

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৯ শতাংশ৷এক মাসে আগে এপ্রিলে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬৮ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার৷অপরদিকে মে শেষে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার৷ গত বছরের মে মাসের তুলনায় বেড়েছে ৩২ দশমিক ৯৮ শতাংশ৷

এ হিসাবে গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি৷ এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের মে শেষে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার৷

এ সময়ে আমদানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে পেট্রোলিয়াম এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য৷ মূলধনী যন্ত্রপাতি রয়েছে তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে৷

দেশের আমদানি ও রপ্তানির এ ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রাখে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স৷ গত অর্থবছরের শেষ সময়ে ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি ছিল৷

রপ্তানি আয় এবং ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে থাকা রেমিট্যান্স মিলে  আমদানি খরচ পূরণ করতে না পারায় চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার৷

Bangladesch Dhaka Arbeiterinnen kehhren aus Saudi-Arabien zurück
ছবি: DW/S. Hossain

চলতি হিসাবে এত ঘাটতিতে বাংলাদেশ এর আগে কখনই পড়েনি৷ গত ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ঘাটতিতে পরে এক সময়ে উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবের ভারসাম্য৷ ওই অর্থবছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার৷ এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার৷ এর আগে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতিই ছিল সবচেয়ে বড়৷

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত৷ এই হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না৷ আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়৷

বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ঘাটতির প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার আর সস্তা হচ্ছে টাকা৷ গত অর্থবছরের শুরুতে থাকা ৮৪ দশমকি ৮১ টাকার ডলারের বর্তমান বিনিময় হয় ব্যাংকিং চ্যানেলেই ৯৩ দশমিক ৪৪ টাকা৷ আর খোলা বাজারে তা এখন ৯৮-১০০ টাকার ঘরে, সম্প্রতি যা ১০২ টাকাতেও উঠেছিল৷

ডলারের সংকট দেখা দেওয়ায় রেমিটেন্স বাড়াতে প্রণোদনার পাশাপাশি নিয়ম শিথিল করছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এতেও খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না৷

ঘাটতিতে সার্বিক ভারসাম্যের উদ্বৃত্ত

আমদানি বাড়ায় এক সময়ে সার্বিক ভারসাম্যের (ওভার অল ব্যালেন্স) উদ্বৃত্তও ঋণাত্বক হয়েছে৷ গত অর্থবছরের মে মাসে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ৮ দশমিক ৫১ বিলয়ন, গত এপ্রিলে তা ঋণাত্বক হয়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়নে৷  আর মে শেষে হয় ঋণাত্বক ৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার৷

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরেও লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত দিয়ে অর্থবছর শুরু করেছিল কিন্তু শেষের দিকে তা ঋণাত্মকে চলে যায়৷

এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)