১২ বছরের পদোন্নতি পেতে লেগেছে ৩৬ বছর
২৩ এপ্রিল ২০১৯ডয়চে ভেলে: ফায়ার সার্ভিসে বর্তমানে লোকবল কত?
আব্দুল মান্নান: বর্তমানে লোকবল আছে ৭ হাজারের কিছু বেশি৷ বর্তমান সরকার, বিশেষ করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জনবল ২৫ হাজারে উন্নীত করার নির্দেশ দিয়েছেন৷ সেই হিসেবে নিয়োগ চলছে৷ এখনো বেশ কিছু সদস্য প্রশিক্ষণে আছেন৷ আরো কয়েকটি নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে৷
দেশে সবগুলো উপজেলাতে কি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে?
আমাদের ১৫৬টি প্রকল্পে কাজ চলছে৷ এই প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের সবগুলো উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হবে৷ আগেও অনেক উপজেলায় ছিল৷ নতুন প্রকল্পে কোনো উপজেলা বাদ যাবে না৷ এখন দু'টি উপজেলা বাকি আছে৷ জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এগুলো এখনো হয়নি৷ তবে প্রকল্প শেষের আগে সবগুলো উপজেলাতেই ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হয়ে যাবে৷
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পদোন্নতি হয় কীভাবে? সঠিক সময়ে পদোন্নতি হচ্ছে কি?
এখানে স্বল্প সময়ে পদোন্নতির সুযোগ নেই৷ এখানে স্টেশন অফিসার হিসেবে রিক্রুট হয়৷ সেখান থেকে পদোন্নতি পেতে পেতে পরিচালক পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব৷ প্রতি ধাপে দুই বছর-তিন বছর করে সময় দেওয়া আছে৷ এই ধাপগুলো পার হয়ে আসতে সময় ততটা থাকে না৷ আমার দৃষ্টান্ত দিয়েই বলি, ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি স্টেশন অফিসার হিসেবে যোগদান করি৷ স্টেশন অফিসার থেকে ওয়্যার হাউজ অফিসার হতে আমার ১৫ বছর সময় লেগেছে৷ আমার অধিকাংশ সময়, বা যদি বলি, সরকারকে কাজ দেওয়ার যে সময়, সেটা স্টেশন অফিসার হিসেবেই কেটে গেছে৷ এই এক বছর আগে আমি ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি৷ আর ছয় মাস আমার চাকরি আছে৷ উপরের পদে এসে যখন অভিজ্ঞ হলাম, তখন আমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে৷ সঠিক সময়ে যদি আমি পদোন্নতি পেতাম, তাহলে ১২ বছরেই আমার উপ-পরিচালক হওয়ার কথা৷ সেখানে আমার সময় লেগেছে ৩৬ বছর৷
বিভাগীয় পদোন্নতি পেয়ে কোন পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব?
আমরা উপ-পরিচালক পর্যন্ত আসতে পারি৷ আমাদের সহকারী পরিচালক হলো ফার্স্ট ক্লাস৷ সহকারী পরিচালক হলে পরবর্তী ১০ বছর লাগে পরের স্কেল পেতে৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সহকারী পরিচালক হতে যে সময় লাগে, তারপর আর ১০ বছর চাকরির বয়সই থাকে না৷ তার আগেই আমাদের অবসরে চলে যেতে হচ্ছে৷ ফলে কেউ পদোন্নতি পেলেও তিনি আর স্কেল পাচ্ছেন না৷ বিদায়ের আগে শুধু সম্মানটুকু নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে৷ আর্থিক কোনো সুবিধা মিলছে না৷
ফায়ার সার্ভিসের বাৎসরিক বাজেট কত? সেটা কি পর্যাপ্ত?
বাজেটটা আসলে অধিদপ্তর থেকে দেখে৷ যতটা বাজেট থাকে তা দিয়েই আমরা সরঞ্জাম কিনি৷ বাজেট যত বাড়বে জিনিসপত্র কেনার তত সুযোগ থাকবে৷ বাজেট আরো বাড়ানোর জন্য আমি অনুরোধ করব৷
আগুন নিয়ন্ত্রণে যেসব যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলো কি পর্যাপ্ত?
এই সরকারের সময় কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে৷ কিছু গাড়ি কেনা হয়েছে৷ যেমন ধরেন, ১৮ তলার যে মই সেগুলো কেনা হয়েছে৷ এখন ঢাকায় দু'টি আর চট্টগ্রামে একটি এমন মই আছে৷ এছাড়াও বেশ কিছু নতুন যন্ত্রপাতি পেয়েছি৷ এভাবে সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি আমাদের হয়ে যাবে৷
খুবই প্রয়োজন, কিন্তু চেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন যন্ত্রপাতি কি আছে?
যেমন ধরেন ১৮ তলা ল্যাডার-এর দু'টি আছে ঢাকা আর চট্টগ্রামে৷ কিন্তু এর বাইরে রাজশাহী, খুলনাসহ বড় শহরগুলোতেও উচু ভবন রয়েছে৷ ওই সব জায়গায় আগুন লাগলে তো নেভানো মুশকিল৷ সেখানে আমাদের ছ'তলা পর্যন্ত মই আছে৷ সেই মই দিয়ে তো আর উঁচু ভবনের আগুন নেভানো যাবে না৷
ঢাকায় এগুলো কতটা আছে?
বড় আছে দু'টি আর ছোট আছে কয়েকটা৷
তাহলে ঢাকা শহরে একই সময়ে একাধিক ভবনে যদি আগুন লাগে তাহলে তো নেভানো মুশকিল হয়ে যাবে, তাই না?
আসলেই কঠিন হয়ে যাবে৷ এ কারণেই সরকার সদয় হয়েছে৷ আমাদের লোকবল বাড়ানো হচ্ছে৷ নতুন নতুন যন্ত্রপাতিও কেনা হচ্ছে৷
আপনাদের বেতন কাঠামোতে কি কর্মীরা সন্তুষ্ট?
আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না৷ মাস দু'য়েক আগেও পুলিশের সৈনিকদের চেয়ে আমাদের সৈনিকদের বেতন বেসিক ২০০ টাকা কম ছিল৷ অথচ এক সময় আমাদের সৈনিকদের বেতন পুলিশের সৈনিকদের চেয়ে বেশি ছিল৷ তাঁরা সময়ের সাথে সাথে কর্মীদের বেতন বাড়াতে পারলেও আমাদের এখানে হয়নি৷ তবে দু'মাস আগে এটা সমান করা হয়েছে৷
ঝুঁকি ভাতা কেমন আছে?
ঝুঁকি ভাতা বিশেষ পদ পর্যন্ত পাই৷ সৈনিক থেকে সহকারী পরিচালক পর্যন্ত পাই৷ চাকরির বয়স অনুযায়ী এটা ভাগ করা আছে৷
মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদেরও তো আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে নামতে হয়?
আগুন যখন লাগে, তখন অফিসার বা সৈনিক বলে কোনো কথা নেই৷ তখন সবাই ফায়ার ফাইটার৷ এটা কেরানিও হতে পারে, উচ্চ শ্রেণির কর্মকর্তাও হতে পারেন৷
অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে মেলালে আপনাদের প্রতিষ্ঠানে বেতন ঘাটতি কেমন?
সরকার সুদৃষ্টি দিলে এই ঘাটতি থাকবে না৷ আমি অনুরোধ করব, সরকার যেন ফায়ার সার্ভিসের প্রতি সুদৃষ্টি দেয়৷
আপনাদের কর্মীদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ আছে?
আগে এতটা ছিল না, এখন বেড়েছে৷ আগামীকালও একটি টিম প্রশিক্ষণ নিতে চীন যাচ্ছে৷ গতকাল আরেকটা টিম প্রশিক্ষণ নিতে ইংল্যান্ড গেছে৷
অনেক সময়ই অভিযোগ ওঠে, ফায়ার সার্ভিস গাফিলতি করেছে, যে কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে৷ কেন এমন অভিযোগ ওঠে?
এই অভিযোগটা আমি ওভাবে মেনে নেবো না৷ বিষয়টা এমন – কোথাও আগুন লাগলে সবাই চায় জীবন বাঁচাতে এবং সম্পদ বাঁচাতে৷ যেমন ধরুন, এক্স-কে বলল ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দিতে৷ সে কি ফোন দিলো, না নিজেই জীবন বাঁচাতে ছুটছে? কেউ ফোন না দিলে তো আমরা জানতে পারি না৷ মেসেজ পাওয়ার পর আমরা ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে বের হয়ে যাই৷ কিন্তু রাস্তার কথা তো আপনাকে বলতে হবে না৷ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমরা কাজ শুরু করলাম৷ কিন্তু আমরা দুই হাজার বা পাঁচ হাজার লিটার পানি নিয়ে যাচ্ছি, যা ২ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়৷ সেখানে কিন্তু আমরা পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছি না৷ আবার ধরেন বস্তিতে আগুন, কেউ দখল করতে আগুন দিয়েছে, তারা চাচ্ছে আমরা যেন সেখানে না পৌঁছাতে পারি, আবার যারা ক্ষতিগ্রস্থ তারা চাচ্ছে আমরা যাতে দ্রুত আগুন নেভাই৷ আরেকপক্ষ সেল্ফি তুলতে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে৷
সার্বিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের মূল সমস্যা কোথায়?
আমাদের আসলে তেমন বড় কোনো সমস্যা নেই৷ জনবল বাড়ানো হলে, যন্ত্রপাতি দেওয়া হলে, আমরা আরো ভালো কাজ করতে পারব৷
ফায়ার কর্মীদের কেউ দায়িত্ব পালনের সময় মারা গেলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা কেমন?
সরকারি আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাই৷ আমাদের একটা কল্যাণ ট্রাস্ট আছে৷ চার বছর আগে এটা হয়েছে৷ সেখানে প্রধানমন্ত্রী ২০ কোটি টাকা দিয়েছেন৷ একটা কল্যাণ তহবিলও আছে৷ রাজশাহীতে কিছুদিন আগে যিনি মারা গেলেন, তাঁকে আমাদের ট্রাস্ট থেকে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে৷
নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন বাঁচান – এটা কি কেবলি চাকরি, না মানবিক দায়বদ্ধতা?
শেষ প্রশ্নটি অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন করেছেন৷ মানবিক দায়বদ্ধতা আমি বলতে পারি না৷ আমার যদি এখানে চাকরির সুযোগ না হতো, তাহলে আমি এই চিন্তা করতাম না৷ আসলে আমার চাকরি তো আছে, যে বেতন দিয়ে আমার পরিবারের ভরণপোষণ হচ্ছে৷ তারপরও আমার জন্য একটা বিশেষ সুযোগ, যেটা অন্য চাকরিতে নেই৷ মানুষের সেবা করার৷ সেটা অভ্যাসবশতই বলেন, আর মন থেকেই বলেন, এই সেবাটা কিন্তু আমরা করে যাচ্ছি৷