হেথা হতে যাও পুরাতন
ভারতীয় জাতিসত্তায় মিশে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির মুখের ভাষা কে কাড়বে? ১৪২৪ বঙ্গাব্দের সূচনায় বাংলার আবেগ, ইতিহাস ও আধুনিকতায় অখণ্ড বাঙালিয়ানারই উদযাপন৷
লালখাতা হালখাতা
কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় লিখেছেন, ‘‘কেবল কলসি উচ্ছুগ্গুকর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন৷’’ ব্যবসায়ী গদিতে বসলে এই লালখাতার অন্য মাহাত্ম্য৷ এতে লেখা থাকে লেনদেন, বাকি-বকেয়ার হিসেবনিকেশ৷পাটোয়ার বাগানে চলছে হালখাতার কেনাবেচা৷
প্যাকেটজাত লৌকিকতা
অতীতের পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের বর্তমান রূপ হালখাতা৷ জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা নিয়ে তাঁদের মিষ্টি খাওয়াতেন৷ পরম্পরা মেনে এখন প্যাকেটে মোড়া হয় মুখমিষ্টির লৌকিকতা৷ মহাত্মা গান্ধী রোডের কাছে একটি মিষ্টির প্যাকেটের দোকান৷
হোর্ডিংয়ের শুভেচ্ছায় জনসংযোগ
শহর ছেয়েছে এমন নানা হোর্ডিংয়ে৷ তাতে ১৪২৪ বঙ্গাব্দের শুভেচ্ছাবার্তা৷ ঝালিয়ে নেওয়া জনসংযোগ, আর এক দফা প্রচারও৷ এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনের সামনে৷
সোনার হরিণ চাই
নতুন বছর কি ভাগ্যে বদল আনবে? মন্দ কপাল খোলে কিনা, পয়লা বৈশাখে তারই পরীক্ষা৷ নববর্ষ বাম্পার লটারির ঘোষণা চারপাশে৷ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডের একটি দোকান৷
পয়লা মানেই পঞ্জিকা
উনিশ শতকে কলকাতার বনেদি বাড়িতে বছর পয়লায় পঞ্জিকা পাঠ হতো৷ ১৮১৮ সালে প্রথম ছাপা পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়৷ ই-সংস্কৃতির যুগেও নতুন বছর এলে পত্রিকার স্টলে অতিথি পঞ্জিকা৷ শিয়ালদহ উড়ালপুলের নীচে একটি দোকানে৷
মার্কেটিং কারে কয়
নববর্ষে অতীতের বটতলায় জন্ম হয়েছিল কলকাতার বাজারের, যা এখন শপিং মলে রূপান্তরিত৷ পণ্যসংস্কৃতি গিলে খেলেও নতুন বছরের আবাহনে মিলে গিয়েছে সেকাল-একাল৷ ধর্মতলার বিপণিতে পয়লা বৈশাখের অফার ঘোষণা৷
চারচাকায় বিপণন
বাঙালির আনন্দ, ফুর্তি, খানাপিনাতেও বিপণনের হাতছানি৷ নতুন বছর তাই বহুজাতিক সংস্থারও পুঁজি৷ ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে শহরজুড়ে পণ্যের প্রচার৷ চিড়িয়া মোড়ের কাছে বাহারি গাড়ি৷
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে
শুভ বৈশাখীতে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রা অখণ্ড বাঙালি সত্তার বিজ্ঞাপন৷ মৌলবাদী হুঙ্কারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে কলকাতাও শক্ত করেছে ঢাকার হাত৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার দিকে দিকে৷
নাচো তো দেখি
হুতোম লিখেছেন, ‘‘কলকেতা সহরের আমোদ শিগগির ফুরায় না৷’’ অতীতে বাঙালির নববর্ষ ছিল চৈত্র সংক্রান্তি আর চড়ক উৎসবেরই বাড়তি একটি দিন৷ একুশ শতকের কলকাতাতেও দুই বছরের সন্ধিক্ষণে আমুদে নাচ হরগৌরীর৷ যশোর রোডের ধারে ফুটপাতে৷
অতি বড় বৃদ্ধ পতি
বাঙালির বারোমাস্যায় একদিকে প্রাচুর্য, অন্যদিকে অনটন৷ ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বর্ণিত বৃদ্ধ শিবের কাহিনি নিয়ে বাঙালির যে চিরায়ত লোকাচার, এ শতকেও সেই পরম্পরা বহমান৷ নাগেরবাজারে মৎস বিক্রেতার কাছে ভিক্ষাপ্রার্থী গৌরী৷ সামনে বহুমূল্য ইলিশ নববর্ষের পাতে পড়ার অপেক্ষায়৷
এসো বসো আহারে
বাঙালি নববর্ষে ‘খাই খাই’ করবে না, তা কী হয়! বিশ শতক থেকেই বাবুবাড়ির হেঁশেলে বিপুল আয়োজন থাকত পয়লা বৈশাখে৷ সরু চালের সুগন্ধী ভাত, ঘন মুগডাল, হরেক ভাজাভুজি, নানা অভিনব পদের প্রাচুর্য নিয়ে এ কালেও তৈরি কলকাতার হোটেল ও রেস্তোরাঁ৷ মধ্য কলকাতার একটি রেস্তোরাঁর নববর্ষের অন্দরসজ্জা৷
বই নিয়ে হইচই
বিশ শতকে নববর্ষে বাবুরা বৈঠকখানায় মজলিস বসাতেন৷ খেমটা, কবিগান, টপ্পা, সঙ, যাত্রায় জমজমাট ছিল বর্ষবরণ৷ সময়ের সঙ্গে বদলেছে উদযাপনের ধরন৷ তাই বছরের শুরুতে এখন শিক্ষিত বাঙালির নয়া পার্বণ বই উৎসব৷ কলেজ স্কোয়ারে তারই বর্ণাঢ্য উদ্বোধন৷
গৃহস্থের উৎসব
সেকালের নববর্ষে বাবু বাড়িতে মেহফিলের আসর মাতাতো সস্তা আতরের গন্ধ, বেলিফুলের মালা৷ বাঈজির গান আর কুলফি মালাইওয়ালাদের ডাক অলিগলি হয়ে রাজপথে মিশত রাতের দিকে৷ এখন ‘বাবু সংস্কৃতি’ অতীত, এ যুগেও গৃহস্থের কাছে নববর্ষ মানে কলাপাতা সাজিয়ে মঙ্গলঘট স্থাপন৷ দমদমের দশকর্মা ভাণ্ডারে তারই যাবতীয় উপকরণ মজুত৷
পরানুকরণে বাঙালি
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সিদ্ধিদাতা গণেশের যোগ সেকালে ছিল না৷ পশ্চিম ভারতের গণেশ আরাধনা বাঙালিকে নববর্ষে গণেশ পুজো শিখিয়েছে৷ হালখাতার সঙ্গে সিদ্ধিদাতার অনিবার্য সহাবস্থান৷ প্রতিমার বিকিকিনি গড়িয়াহাটের কাছে৷
নববর্ষ সংখ্যা
কবি ও সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্ত বাংলা নববর্ষে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর বিশেষ সংখ্যা বের করেছিলেন৷ সেই পরম্পরায় আজও প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ নববর্ষ সংখ্যা৷
মধুর তোমার শেষ যে না পাই
এককালে বাঙালির পাতে পড়ত ঘরে তৈরি মিষ্টির সম্ভার৷ সেই নারকেল নাড়ু, ছানার জিলিপি, সন্দেশ, মালপোয়া ঠেলে বাঙালি এখন অবাঙালি লাড্ডু-বরফি-শোনপাপড়ির প্রেমে মজেছে৷ উৎসব মুহূর্তে কালিন্দিতে মিষ্টির দোকানে ভিড়৷
সম্প্রীতির নতুন বছর
ধর্মের নামে বাঙালির মধ্যে ভেদ সৃষ্টির বিরুদ্ধে সেরা বিজ্ঞাপন বাংলা নববর্ষ৷ হাবড়ার মকবুল শেখ নববর্ষে হিন্দু গৃহস্থের পুজোর উপকরণ ডাব, কলাপাতা নিয়ে বসেছেন৷ দমদম রোডের ধারে দিনভর দারুণ বিক্রি, হাসি ফুটেছে মকবুলের মুখে৷