হাসছে মন্ত্রী, কাঁদছে দেশ!
৩০ জুলাই ২০১৮দেশের ২৪ ঘণ্টার টিভি চ্যানেলে কাজ করার সুবাদে খুবই অপ্রিয় এক অলিখিত নিয়ম মেনে নিতে হয়েছিল৷ কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আগে খোঁজ নেয়া হতো, সংখ্যাটা কত৷ পাঁচের কম হলে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ‘জাস্ট ইন' বা ‘সর্বশেষ', পাঁচ বা তার বেশি হলে তবেই কেবল ‘ব্রেকিং'৷
সড়কে দুর্ঘটনা এতটাই সাধারণ এবং স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে যে, ‘অল্প সংখ্যক মৃত্যু' পত্রিকাতেও আর এক কলামের বেশি স্থান পায় না৷ প্রতিটি মৃত্যুই যে এক একটি সংখ্যাই কেবল, তা আরো একবার হেসে হেসে মনে করিয়ে দিলেন নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খান৷
দুর্ঘটনায় আহত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সাইদুর রহমান পায়েলকে গত ২১ জুলাই অচেতন অবস্থায় সেতু থেকে খালে ফেলে দেয় হানিফ পরিবহণের চালক ও তার সহকারীরা৷ গত সোমবার মুন্সিগঞ্জের ভাটেরচর সেতুর নিচের খাল থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে৷
২৯ জুলাই দুপুরে ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহণের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়৷ ২৯ জুলাই সচিবালয়ে মংলা বন্দরের জন্য মোবাইল হারবার ক্রেন কেনার চুক্তিপত্র স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এ দুই দুর্ঘটনা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খান বললেন বটে, ‘‘যে অপরাধ করবে সে অপরাধের শাস্তি তাকে পেতে হবে৷'' কিন্তু তাঁর অঙ্গভঙ্গি এবং হাসিমুখই বলে দিচ্ছিল, প্রশ্নের গতবাঁধা জবাব দিয়ে কোনোরকমে এড়িয়ে যাওয়াই ছিলো তাঁর লক্ষ্য৷
মন্ত্রী প্রশ্ন করতেই পারতেন, ‘‘আমি নৌ-মন্ত্রী, আমাকে কেনো সড়ক নিয়ে প্রশ্ন করছেন?'' কিন্তু তিনি ভালো করেই জানেন, পালটা এ প্রশ্ন করার নৈতিক ভিত্তি তিনি অনেক আগেই হারিয়েছেন৷ কারণ, নৌ-মন্ত্রী হলেও একই সাথে তিনি পরিবহণ শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতিও বটে!
তারপরও সাংবাদিকরা তাঁকে চেপে ধরেন৷ উত্তরে মন্ত্রী যা বললেন, তা শুধু, নিজেকেই খাটো করা হলো না, খাটো করলেন তাঁর পুরো সরকারকেই৷ মাত্র কয়েকদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশকে ‘প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড' বানানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন, তখন তাঁর মন্ত্রী কিনা সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশকে তুলনা করছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে?
‘‘আমি যদি আপনাদেরকে প্রশ্ন করি, গতকাল আপনারা লক্ষ্য করেছেন, ভারতের মহারাষ্ট্রে একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে ৩৩ জন মারা গেল৷ কই ওখানে তো এভাবে কেউ কিছু বলেনি?''
মাননীয় মন্ত্রী, চলুন তাহলে ‘প্রধানমন্ত্রীর সুইজারল্যান্ডকে' বাদ দিয়ে ‘আপনার ভারতকেই' আমরা আমাদের মডেল হিসেবে ধরে নেই৷
বেশিদিন আগে নয়, ২৪ জুলাই থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বিশ্বে নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হিসেবে এসেছে ভারতের নাম৷ এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান এবং সিরিয়ার চেয়েও এগিয়ে ভারত৷ আসুন, আমরা ভারতকেই মডেল হিসেবে মেনে নেই৷
২০১৭ সালের সিআইডি ফ্যাক্টবুকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে বাংলাদেশে মারা যায় ৩১ দশমিক ৭ জন, ভারতে এ সংখ্যা ৩৯ দশমিক ১৷ ও আচ্ছা, সুইজারল্যান্ডে এ সংখ্যা ৪ দশমিক ১৷
এবার তুলনা করি ‘ইচ্ছেকৃত হত্যাকাণ্ডের'৷ জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক অফিস – ইউএনওডিসি বলছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ২ দশমিক ৫০ জন৷ ভারতে ২০১৬ সালের হিসেব বলছে, এ সংখ্যা ৩ দশমিক ২২৷ মাননীয় মন্ত্রী শুনে হয়ত আরেকটু হেসে নিতে পারেন, সুইজারল্যান্ডেও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, লাখে দশমিক ৫ জন, অর্থাৎ দুই লক্ষে একজন৷
এমন আরো হাজার হাজার উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে আমরা পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছি৷ সরকার সেগুলোকে রীতিমতো নিজেদের সাফল্য হিসেবে প্রচার করে৷ সে জায়গায় মন্ত্রীর বক্তব্য শুনে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া উপায় দেখি না৷
ফলে ভারত নিজেই যেখানে বাংলাদেশের মতোই একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে সে দেশকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো মন্ত্রীর মুখে শোভা পায়? একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, ভারতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আছে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী ধর্মভিত্তিক দল৷
আবার ফিরি সংবাদ সম্মেলনে৷ তারপরও সাংবাদিকরা চেপে ধরলে শাহজাহান খান বলেন, ‘‘আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, যে যতটুকু অপরাধ করবে সে সেভাবেই শাস্তি পাবে৷ যে শাস্তি হবে সেই শাস্তি নিয়ে কেউ কোনো….এগুলোর বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ এখানে নেই৷''
মাননীয় মন্ত্রী, ‘বিরোধিতা করার সুযোগ নেই' শব্দগুচ্ছগুলো দিয়ে আরও প্রমাণ করলেন তিনি যা চাইবেন সেটাই হবে৷ আপনার-আমার সেখানে বলার কিছু নেই, গবেষণার কোনো প্রয়োজন নেই, আসুন আমরা সামান্য একটা কাজ করি৷ ইন্টারনেট ব্যবহার করে গুগল সার্চ ইঞ্জিনে ‘চালক সাজা অবরোধ' লিখে সার্চ দেই৷
সার্চের ফল হিসেবে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কি কি সংবাদের লিংক পাওয়া যায় দেখতে পাচ্ছেন কি? কষ্ট কমাতে আমি আরো সহজ করে দেই৷
১. চালককে সাজা দেওয়ায় মহাসড়ক অবরোধ – ২৫ নভেম্বর, ২০১৩ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
২. চালকের সাজার প্রতিবাদে ঝিনাইদহে সড়ক অবরোধ – ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ (জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর)
৩. বেপরোয়া চালকের সাজার প্রতিবাদে চুয়াডাঙ্গায় ধর্মঘট চলছেই – ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ (প্রথম আলো)
৪. সাজাপ্রাপ্ত চালককে ছাড়িয়ে নিলো পরিবহন শ্রমিকরা – ১৩ অক্টোবর, ২০১৫ (জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর)
এবার আসুন সুইজারল্যান্ডের পরিস্থিতিও একটু দেখে আসি৷ আবার একটু গুগল সার্চ দিতে হবে৷ অনেক কষ্টে এবার পাওয়া যাবে কিছু দুর্ঘটনার খবর, যাতে যাত্রীরা সামান্য আহত হয়েছেন এবং সেটাও সেদেশের পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে৷
আরেকটা খবর পাওয়া যাবে৷ সেটি গত বছরের খবর৷ সুইস ইনফো নামের পত্রিকা বলছে, গত ৮০ বছরের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে রেকর্ড পরিমাণ৷
মন্ত্রী শাহজাহান খান ২০১১ সালে বলেছিলেন, গরু-ছাগল চিনলেই চালকদের লাইসেন্স দেয়া যায়৷ উন্নত দেশে এমন কথা বললে যে কোনো মন্ত্রীরই রাজনৈতিক তো বটেই, সামাজিক ইমেজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো বলাই বাহুল্য৷ অথচ, এমন কথা বলা মন্ত্রী এখনও ৭ বছর পর একই ধরনের ঘটনায় অট্টহাসি হাসেন৷
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, এমন ঘটনার দায় কেন মন্ত্রীরা নেন না৷ কেন? সব সাফল্যের কৃতিত্ব আপনাদের, সব ব্যর্থতার দায় কে নেবেন? ঈশ্বর?
সংবিধানে আছে, জনগণই ক্ষমতার উৎস৷ যদি সত্যিই তা হয়ে থাকে, জনগণের জানার অধিকার আছে দেশ কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘উন্নত সুইজারল্যান্ডের' দিকে, নাকি নৌ-মন্ত্রীর ‘উন্নয়নশীল ভারতের' দিকে?
বিদ্রোহী কবি বলে গিয়েছিলেন, ‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, কান্ডারী আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!' কিন্তু এমন অনুভূতিহীন মন্ত্রীরা যতদিন আমাদের কাণ্ডারী, আপাতত বোধহয় বঙ্গোপসাগরের দিকেই ধাবিত হতে থাকবে বাংলাদেশ৷
বন্ধু, ব্লগপোস্টটি কেমন লাগলো? জানান নীচের ঘরে৷