স্বৈরশাসকের ‘বিরুদ্ধে' আবার সফল রিচার্ডসন
১৬ নভেম্বর ২০২১উত্তর কোরিয়া, ইরাক, ইরান, মিয়ানমার- যেখানেই আটক মার্কিন নাগরিক, সেখানেই ছুটে যান বিল রিচার্ডসন৷ এ কারণে গত ২৭ বছরে অনেকবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন কূটনীতিক থেকে ‘ফ্রিল্যান্স-ফিক্সার' হয়ে যাওয়া এই মার্কিন নাগরিক৷ তার সর্বশেষ সাফল্য ‘ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমার' নামের অনলাইন ম্যাগাজিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ড্যানি ফেনস্টারকে মিয়ানমার থেকে মুক্ত করা৷ সরকারবিরোধী আন্দোলনে উসকানি দেয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগে গত সপ্তাহেই ৩৭ বছর বয়সি ফেনস্টারকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেয় মিয়ানমারের আদালত৷ তাকে মুক্ত করার আশা দৃশ্যত ছেড়েই দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার৷ তবে আশা ছাড়েনি ফেনস্টারের পরিবার৷ প্রিয়জনকে মুক্ত করতে তারাও ভরসা রেখেছিলেন বিল রিচার্ডসনের ওপর৷ বলা বাহুল্য, ভরসার ষোল আলা মর্যাদা রেখেছেন নিউ মেক্সিকোর সাবেক গভর্নর৷
বিল রিচার্ডসনের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার
১৯৯৪ সালে বিল রিচার্ডসন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য৷ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন তখন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত এক চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছেন৷ চুক্তির বিষয়ে আলোচনার জন্য উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন রিচার্ডসন৷ কিন্তু পিয়ংইয়ং-এ পৌঁছানোর আগেই ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা৷
যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক হেলিকপ্টার উত্তর কোরিয়ার আকাশসীমায় ঢুকে পড়ায় গুলি চালায় উত্তর কোরীয় সেনাবাহিনী৷ গুলিতে বিধ্বস্ত হয় হেলিকপ্টার৷ নিহত হন এক পাইলট৷ অন্যজনকে আটক করে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী৷ ফলে বাধ্য হয়ে কয়েক সপ্তাহ পিয়ংইয়ংয়ে থাকতে হয় রিচার্ডসনকে৷
পিয়ংইয়ং থেকে ফেরার পরই ইরাকে যেতে হয় তাকে৷ কুয়েত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই নাগরিক৷ তাদের আটক করে ইরাকের সীমান্তরক্ষী বাহিনী৷ দুই সহনাগরিককে ছাড়ানোর জন্যও ডাক পড়েছিল রিচার্ডসনের৷ ব্যর্থ হননি৷ ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে আটকে পড়া দুজনকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে এনেছিলেন রিচার্ডসন৷
কেমন করে স্বৈরাচারী শাসকদেরও প্রাভাবিত করে সফল হয়ে ফেরেন? ২০১৮ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনকে এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন সাবেক কূটনীতিক বিল রিচার্ডসন ৷ এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, যে কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনায় তার প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে পারস্পরিক সম্মান নিশ্চিত করা৷ তার মতে, ‘‘সমঝোতায় পৌঁছাতে চাইলে তাদেরও (প্রতিপক্ষ) সম্মান দিতে হবে আপনাকে৷... তাছাড়া অন্যপক্ষ যাতে মুখরক্ষার একটা সুযোগ পায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে, এমন একটা পথ বের করতে হবে যাতে তারাও কিছুটা কৃতিত্ব বা আলোচনা থেকে কিছু একটা যেন পায়৷''
বিল ক্লিন্টনের সময়ে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত করা হয় রিচার্ডসনকে৷ ক্লিন্টনের বিদায়ের পর আবার ফেরেন রাজনীতিতে৷ ২০০২ সালে নিউ মেক্সিকোর গভর্নর নির্বাচিত হন রিচার্ডসন৷ তারপর ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থীও হতে চেয়েছিলেন৷ তবে সে আশা পূরণ হয়নি৷
তাই বলে হতোদ্যম হয়ে অবসরে চলে যাননি বিল রিচার্ডসন৷ বরং বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন সেন্টার ফর গ্লোবাল এনগেজমেন্ট নামের প্রতিষ্ঠান৷ প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আটক বা নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা৷ মার্কিন সরকারের সহায়তায় সেই ব্যক্তিদের পরিবারের অনুরোধেই কাজ করেন তারা৷
২০১৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের হয়েই গুগলের সিইও এরিক শ্মিড্টের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন রিচার্ডসন৷ লক্ষ্য ছিল কোরিয়ান-অ্যামেরিকান মিশনারি কেনেথ বে-কে মুক্ত করা৷ ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ছাত্র অটো ওয়ার্মবিয়ারকে ছাড়াতেও উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন তার পরিবারের অনুরোধে, সেন্টার ফর গ্লোবাল এনগেজমেন্টের হয়ে৷ খুব কাহিল অবস্থায় ওয়ার্মবিয়ারকে দেশে ফিরিয়েছিলেন ঠিকই, তবে ফেরার পর বেশিদিন বাঁচেননি তরুণ শিক্ষার্থী৷
এছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে দুবার ইরানেও গিয়েছেন বিল রিচার্ডসন৷ প্রথমবার গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ছাত্র শিয়ে ওয়াংকে মুক্ত করতে৷ পরেরবার লক্ষ্য ছিল ইরানে আটক নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মাইকেল হোয়াইটকে ছাড়িয়ে আনা৷ ইরান সরকারকে রাজি করিয়ে দুবারই যুক্তরাষ্ট্রের দুই নাগরিককে ফিরিয়ে এনেছিলেন বিল রিচার্ডসন৷
মিয়ানমারে রিচার্ডসনের অতীত ও বর্তমান
সোমবার ছিল বিল রিচার্ডসনের ৭৪তম জন্মদিন৷ এমন দিনেই সাংবাদিক ফেনস্টারকে মুক্তি দেয়ার খবর প্রচার করে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী পরিচালিত টিভি চ্যানেলে৷ সেখান বলা হয় ‘মানবিক কারণে' মুক্তি দেয়া হয়েছে ফেনস্টারকে৷ কয়েকদিন আগেই মিয়ানমারের আদালত যাকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল, তাকে মুক্ত করে টুইটারে ফেনস্টারের সঙ্গে নিজের ছবিও পোস্ট করেছেন রিচার্ডসন৷
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে এর আগেও একাধিকবার আলোচনায় বসেছেন তিনি৷ ১৯৯০-এর দশকে গিয়েছিলেন তখনকার গৃহবন্দি নেত্রী অং সান সুচিকে মুক্ত করতে৷ ২৮ বছর পর আবার যেতে হয়েছিল মিয়ানমারে৷ তখন নোবেলজয়ী সুচি ক্ষমতায়৷ তাই তার সঙ্গেই বসেছিলেন রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে কারামুক্ত করার বিষয়ে কথা বলতে৷ আবার পালাবদল হয়েছে মিয়ানমারে৷ সুচি আবার কারাগারে৷ আবার ক্ষমতায় সেনাবাহিনী৷ আবার আলোচনায় বসলেন রিচার্ডসন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ফেনস্টারকে মুক্ত করতে৷ আবার সফল হয়েই ফিরলেন তিনি৷
এসিবি/ কেএম (রয়টার্স)