সন্তানদের আত্মহত্যার কারণ কী?
১৩ জুন ২০১৬এছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যস্ততাকেও দায়ী করেছেন তিনি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বা শিক্ষা ও পরামর্শ মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম ডয়চে ভেলেকে এ সংক্রান্ত একটি সাক্ষাৎকারে বলেন এ কথাগুলো৷ তারই একটা অংশ এখানে তুলে ধরা হলো৷
ডয়চে ভেলে: আগের তুলনায় বাংলাদেশে কি আত্মহত্যার হার বেড়েছে?
মেহতাব খানম: পরিসংখ্যানটা সঠিক বলতে পারবো না৷ তবে এটা বলতে পারি যে, আমাদের সমাজে একটা পরিবর্তন এসেছে৷ সমাজে, রাষ্ট্রে যখন একটা পরিবর্তন আসে, তার প্রভাব পড়ে মানুষের মনে৷ এই যেমন, যন্ত্রের মাধ্যমে বেশি যোগাযোগ হচ্ছে৷ এর ফলে মানুষ অনেক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে৷ যেগুলো খুব স্থায়ী সম্পর্ক নয়৷ বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে৷ সমাজের সবক্ষেত্রে একটা অবক্ষয় ঘটেছে৷ যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে অবক্ষয়, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবক্ষয় এসেছে৷ বিয়ের সম্পর্কগুলো ভালো থাকছে না৷ সম্পর্কের অবনতি ঘটছে৷ আর এ জন্য প্রযুক্তি একটা বড় ভূমিকা রাখছে৷
সামাজিক যোগাযোগের নেতিবাচক দিকটা কী?
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সবাই কিন্তু নিজের ভালো জিনিসগুলো শেয়ার করে৷ কে কোথায় ঘুরতে যাচ্ছে, কোথায় খেতে যাচ্ছে৷ কোন কনসার্টে গেলো, কী ভালো লাগলো – এ সব৷ এতে করে যে মানুষটা হতাশায় ভুগছে সে আরো ভাবে পৃথিবীর সব মানুষ কত আনন্দে আছে, যত দুঃখ সব তাদের৷ আমার কাছে যত হতাশা নিয়ে ‘ক্লায়েন্ট' আসে৷ আর এ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যারা বেশি ফেসবুক ব্যবহার করে, তারা বেশি হতাশাগ্রস্ত৷ তাদের অনেকেই এই কথাটা বলতে শোনা যায়৷ সরাসরি ‘শেয়ারিং'-এ যে ভাবের আদান-প্রদান হয়, সেটা কি আর যন্ত্রের মাধ্যমে সম্ভব!
কাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি?
পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বেশি৷ বয়ঃসন্ধি থেকে নিয়ে ২৫ থেকে ৩০ বয়সি নারীদের অনেকেই হতাশাগ্রস্ত৷ তাই তাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতাও বেশি৷ একটা বিষয় হচ্ছে আজ সমাজে সবকিছুই কেমন এগিয়ে আসছে৷ মানসিক অসুস্থতার বয়সটাও এগিয়ে আসছে৷ মাত্র সাত বছর বয়সি ছেলেও বিষণ্ণতা নিয়ে আমার কাছে আসছে৷ যেটা আগে মোটেও দেখা যেত না৷ আর এটা পরিবারের কারণেই হচ্ছে বেশি৷
এর প্রতিকার আসলে কী? আসলে পরিবার এক্ষেত্রে কি ভূমিকা রাখতে পারে?
মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টা বাংলাদেশে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না৷ কয়েকটা ‘ইনস্টিটিউশন' বা সংগঠন আছে যা অপ্রতুল৷ ঢাকার বাইরে খুব কম৷ মানুষের যখন আত্মহত্যার প্রবণতা হয়, তখন তারা সাহায্য খোঁজে৷ যে মডেল আত্মহত্যা করার আগে ফেসবুকে ভিডিওটি দিয়ে গেছে, সে কিন্তু সবার সাহায্য চাইছে এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য৷ তার অনেক বন্ধুও তাকে সাহায্য করতে চাইছে৷ এই সাহায্যটা যদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে না হয়ে সরাসরি হতো, মেয়েটা হয়ত বাঁচত৷ তাছাড়া দেশে ‘হেল্পলাইন'-ও বেশি নেই৷ যখন এমন প্রবণতা হবে তখন যদি কাউকে তার সমস্যাটা বলতে পারে, তবে আত্মহত্যার ইচ্ছেটা চলে যাবে৷ অনেক ‘ক্রাইসিস সেন্টার' যদি থাকে তবে ভালো হয়৷ কেবল একটি সরকারি ক্রাইসিস সেন্টার রয়েছে, যা যথেষ্ট নয়৷ কেননা সব মানুষ সেখানে ফোন করছে, তারা সামাল দিতে পারছে না৷
পরিবারের ব্যাপারটা হলো আগের মতো কেউ পরিবারের সাথে বেড়াতে যায় না, গল্প করে না৷ কেননা মানুষে মানুষে যোগাযোগটা আগের তুলনায় যন্ত্রের মাধ্যমে একটু বেশি হচ্ছে৷ আগে যেখানে সরাসরি হতো৷ পরিবারে হয়ত চারজন মানুষ আছে৷ বাসায় ফিরে চারজনই চারটি মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করছে৷
আগের মতো পিকনিকেও খুব একটা যায় না মানুষ৷ আর বাইরে যেতেও ভয় পায়, কারণ এত দুর্ঘটনা হয়, তা নিয়েও মানুষ দুশ্চিন্তায় ভোগে৷ নিজেদের বিনোদনটায় আজকাল মানুষ বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে৷ তাই যন্ত্রের সাথে বেশি সময় কাটাচ্ছে৷ কেউ কষ্টের জায়গাগুলো ফেসবুকে দিচ্ছে না৷ যারা বিষণ্ণতায় ভুগছে তাদের বিষণ্ণতাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে ফেসবুক৷ অন্যদের আনন্দ করতে দেখে এটা আরো বাড়ছে৷ তাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, যেমন ফেসবুক, টুইটারে যোগাযোগ না বাড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে৷
পরিবারের মানুষ কোন লক্ষণ দেখে বুঝবেন যে তার সন্তান বা আত্মীয় বিষণ্ণতায় ভুগছেন, বা তার সাহায্যের প্রয়োজন?
কেউ যদি খিটখিটে মেজাজের হয়, হয়ত বেশি খাচ্ছে বা কম খাচ্ছে৷ ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা, অল্পতেই রেগে যাওয়া, মানুষকে আঘাত করা, দৈননন্দিন কাজে ধীরগতি, উদ্বেগ – এ সবই বিষণ্ণতার লক্ষণ৷ বিষণ্ণতার অন্যতম প্রধান কারণ দাম্পত্য সম্পর্কে দ্বন্দ্ব ও অসামঞ্জস্যতা৷ বাবা-মা কেউ কাউকে সইতে পারছে না, সম্মান করছে না –এটা সন্তানদের মধ্যে বিষণ্ণতা তৈরি করছে৷ আর মা-বাবার দোষ দিয়েও লাভ নেই, তারা যখন নিজেরা খারাপ আছেন, তখন আর কে খারাপ থাকলো সেদিকে লক্ষ্য করেন না৷ কিছু পরিবারের বিয়ের পর প্রথমদিকেই স্ত্রীর ওপর শ্বশুরবাড়ির একটা নেতিবাচক প্রভাব থাকে৷ দুই পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য৷ তারা একে-অপরকে ছোট করছে, দোষারোপ করছে৷ এতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে৷ পরে দুই পরিবার হয়ত চেষ্টা করে সমঝোতা করতে৷ পরে কাউন্সেলিং-এ আসে৷ দুই পরিবারের সম্পর্কের অবনতিতে শিশুদের সাথে পরিবারের অন্য সদস্যদের মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়৷ এতে মানসিকভাবে চাপ পড়ে শিশুদের ওপর৷
প্রেমের সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণটা কী?
প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্ক গড়তে গেলে প্রথমেই বাবা-মায়ের সম্পর্কের দিকে সন্তানের চোখ পড়ে৷ তাদের সম্পর্ক যদি ভালো না হয়, তবে সুস্থ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না৷ গর্ভকালীন অবস্থায় বাচ্চার ওপর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব পড়ে৷ তাই বাবা-মাকে অনেক বেশি যত্নশীল হবে৷ এখনকার যুগে ছেলে বা মেয়ে একে অপরকে চাপ দেয়ার চেষ্টা করে৷ তুমি এটা করতে পারবে না, ওটা করতে পারবে না – এ সব শর্ত জুড়ে দিচ্ছে একে অন্যকে৷ এ সব শর্ত ভঙ্গ হলেই সম্পর্কে চিড় ধরছে৷ এই চাপ সৃষ্টির কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সুস্থ সম্পর্ক৷
আত্মহত্যার প্রবণতা হলে কী ধরনের থেরাপি আপনারা দেন?
প্রথমেই শুরু করি পরিবারের ধরণ কেমন, বাবা-মা এর সম্পর্ক কেমন সেটা দিয়ে৷ অতিরিক্ত শাসন বা অতিরিক্ত ভালোবাসা – দু'টোতেই সমস্যা সৃষ্টি হয়৷ মা যখন শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর কাছ থেকে কষ্ট পেয়েছেন, সেটা শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে৷ কষ্টের পাশাপাশি রাগও জমা হতে থাকে৷ যেমন একজন আমার কাছে এসে বলছে, তার বাবাকে আঘাত করতে বা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে উচ্ছে হতো, কিন্তু বাবা তো তাই সেটা সে পারেনি৷ বাবা-মার হাতাহাতিও হয়েছে৷ তাই মানসিক বিকাশ কীভাবে ঘটছে সেটা প্রথমে দেখি৷ ‘ইমোশনাল ডেভেলপমেন্ট'-কে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করি৷ আবেগ, রাগ, কষ্ট কতটা মোকাবেলা করতে পারছে সে৷ এগুলোকে যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তখন সম্পর্ক ভালো হয়৷ যখন নিজে ভালো থাকবে, নিজেকে যত্ন করতে ইচ্ছে করবে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে, তখন অন্যের সাথে সম্পর্ক ভালো হবে৷ তাই ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স গড়ে তুলতেও সাহায্য করি আমরা৷
মনোবিজ্ঞানী মেহতাব খানমের সাক্ষাৎকারটি আপনাদের কেমন লাগলো? লিখুন নীচের ঘরে৷