স্বপ্ন কিনতে বেচে দেয়া শ্রেষ্ঠ সময়
২০ জুন ২০১৭যে স্বপ্ন কিনতে এত বড় বিনিময়মূল্য পরিশোধ করতে হয়, সেটাই বা তারা কতটা কিনতে পারেন – এ সব তুলে এনেছেন আলোকচিত্রী, লেখক শহিদুল আলম৷
কুমিল্লার আবুল হোসেনরা ৫ ভাই-বোন৷ এই পাঁচজনকে নিয়ে ছোটবেলায় অকূলপাথারে পড়েন মা৷ গার্মেন্টসে কাজ করার মতো শারিরীক অবস্থাও তাঁর ছিল না৷ তাই তিনি মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেন৷
এই আয় থেকে এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরাতো, সেখানে শিক্ষা ছিল আরো অধরা৷ এ কারণে আবুল খুব একটা পড়াশোনা করতে পারেননি৷ কষ্টের জীবন শেষ করতে এক সময় দালাল ধরে আবুল যান মালদ্বীপ আর বাবুল যান মালয়েশিয়া৷ মালদ্বীপে সুবিধা করতে না পেরে এক সময় আবুলকে দেশে চলে আসতে হয়৷
এরপর একই দালাল তাঁকে মালয়েশিয়া যেতে বলে৷ সেই অনুসারে মালয়েশিয়া যানও তিনি৷ দুই বছর পর ফিরে এসে বিয়ে করেন আবুল৷ তবে বিয়ের পরও তাঁকে আবার বিদেশের পথে পা বাড়াতে হয়৷
এবার যাওয়াটা অবশ্য কঠিনই ছিল৷ কারণ, বাড়িতে অপেক্ষমান মানুষের তালিকায় আরো একজন যোগ হয়েছে৷ সেই আবুলের স্ত্রী আমেনা আক্তারও স্বামীকে বিদেশে যেতে দিতে চাননি৷ তার কথা ছিল, জীবন চলুক না হয় একটু টানাটানিতে৷ তবু এক সাথে থাকাই ভালো৷
সন্তানকে পাশে রাখতে চান আবুলেরও মা-ও৷ কিন্তু তিনি বাস্তবতা জানেন৷ জানেন জীবনের নির্মমতাও৷ তাই শেষ পর্যন্ত বিদেশ যাওয়ার পক্ষেই মত দিলেন তিনি৷
আবুলের ভাই বাবুল মিয়ার একটি সন্তান জন্মেছে৷ ভাবী হালিমা আক্তারের কাছেই বড় হচ্ছে সে৷ সন্তানকে নিরাপদ ভবিষ্যত দিতেই এই বিদেশ যাত্রা, সেই সন্তানের মুখদর্শনের সুযোগ এখনো হয়নি তাঁর৷
শহিদুল আলমের লেখনি আর ছবিতে উঠে এসেছে শাহনাজ পারভীনের জীবনও৷ এক বছর বয়সি ছেলেকে স্বপ্নভরা জীবন দিতে তিনি মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন৷ সন্তান বড় হয়েছে বোনের কাছে৷ ১০ বছর পর এসে সেই সন্তান পড়ছে ক্যাডেট কলেজে৷
এছাড়াও বাড়িতে জমি কিনেছেন তিনি৷ ফিরে এলে নিজের মতো করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন বলেও আশা করেন৷ তবে যে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে তিনি প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেই সন্তান এখন শাহনাজকে ‘খালা’ ডাকে৷ আর শাহনাজের বোনকে ডাকে ‘মা’৷জীবনে সব কষ্ট অনায়াসে সামাল দিতে পারলেও এই কষ্ট কোনোভাবেই সামাল দিতে পারেন না শাহনাজ৷
শাহনাজ আর আবুলদের জীবনের গল্প নিয়ে ‘দ্য বেস্ট ইয়ার্স অফ মাই লাইফ’ শীর্ষক এই প্রদর্শনী হচ্ছে জার্মানির গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের অনুষ্ঠানস্থলে৷ এর আগেও বাংলাদেশে দু’টো প্রদর্শনী হয়েছে৷
শহিদুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি অভিবাসীদের জীবন নিয়ে অনেক বছর যাবত কাজ করছি৷ ফ্রান্সে একটা জায়গায় বাঙালিরা থাকে, একটা পর্যায়ে সেখানে এক দোকান মালিক আমাকে বাসায় নিয়ে যান৷ গিয়ে দেখি, এক বিছানায় ৮ ঘণ্টা করে একজন থাকে৷ ডাবল বেডে দিনে ছয় জন থাকে৷ সেখানকার এক ভদ্রলোক ফুল বিক্রি করতেন৷’’
‘‘তিনি আমাকে বললেন, এখানে ভালোই থাকি যখন বৃষ্টি পড়ে না, পুলিশ তাড়া দেয় না৷’’
ফুল বিক্রি করে দেশে টাকা পাঠানো এই ব্যক্তিকে উদ্ধৃত করে শহিদুল প্রশ্ন রাখেন, ‘‘হয়তো বোনের বিয়ে হবে, বাবা জমি কিনবে বা ভাইয়ের একটা দোকান থাকবে৷ কিন্তু আমার যৌবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো যে দিলাম, সেটা আমাকে কে ফেরত দেবে?’’
১৯৯৬ সালে দেখা হওয়া সেই ব্যক্তির কথা মনে রেখে এই প্রদর্শনীর নাম দেয়া হয় ‘দ্য বেস্ট ইয়ার্স অফ মাই লাইফ’৷ তবে প্রদর্শনী ছবিগুলো ২০১৬ সালের৷ শহিদুল আলম একজন শ্রমিকের বাংলাদেশের বাড়িতে যান৷ সেখান থেকে তাঁর সঙ্গে পাড়ি জমান মালয়েশিয়া পর্যন্ত৷ সেখান থেকে তাঁদের জীবনের নানা চিত্র তুলে এনেছেন৷
পৃথিবীতে মারাত্মক অসমতার কারণে মানুষ শেষ পর্যন্ত এত কষ্ট করতে রাজি থাকে বলে মনে করেন শহিদুল আলম৷
এক প্রশ্নের জবাবে শহিদুল জানান, ‘‘এ কারণেই বিদেশে যেতে মানুষ সর্বোচ্চ ঝুঁকিও নেয়৷ এসব সমস্যার সমাধানে একটি সমতার পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷’’
অভিবাসীরা অনেক সময় যে অসততার আশ্রয় নেন তা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দিন শেষে বলতে হবে, এগুলো হচ্ছে, কারণ, পৃথিবীতে অসমতা রয়েছে৷ কিছু দেশ আমাদের দেশকে শোষণ করে বড়লোক হয়েছে৷’’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রবাসে বাংলাদেশিদের দুর্দশার অবসান করতে এটাকে কেন্দ্র করে যে সব ব্যক্তি লাভবান হয়, সেই চক্র ভাঙতে হবে৷