1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বপ্ন এবং জার্মানি, পর্ব ৭

ফারজানা কবীর খান২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯

ডয়চে ভেলে থেকে কাজ শেষ করে রোজ ট্রামে চড়ে বাড়ি ফিরি আমি৷ ঘরের ফেরার পথে ট্রাম থেকে আমি রোজ দেখতে পাই সাত পাহাড়ের উপর এক বিশাল প্রাসাদ৷ প্রাসাদ, মহল না ভবন জানিনা আমি৷ এক অজানা আকর্ষণ শুধু টানে আমায়৷

https://p.dw.com/p/H0Tt
হোটেলটির নাম পেটার্সব্যার্গ৷ছবি: AP

একদিন আমার অদমনীয় আকর্ষণ টেনে নিয়ে গেল আমায়৷ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে আমি ট্রামে চড়ে ‍পৌঁছালাম ক্যোনিগসভিন্টারের রাইন নদীর পাশে৷ রাইন নদীর পূর্বদিকে সাত পাহাড়ের মাঝে জাজ্বল্যমান সেই ভবনটি শুধু টানছে আমায়৷ আজ জানতেই হবে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মহলটিকে৷

কিন্তু ক্যোনিগসভিন্টারে এসে দেখি সেখানে থেকে সাত পাহাড়ে পৌঁছাতে হলে আমাকে ট্যাক্সি নিতে হবে৷ কারণ ট্রাম বা বাস সেখানে পৌঁছায় না৷ পায়ে হেঁটে এত দূর পাহাড়ে চড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ কিন্তু দূর পাহাড়ের ধারে দিগন্তের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদের রহস্য যে জানতে হবে আমাকে৷ অগত্যা ট্যাক্সি ভাড়া করে পৌঁছালাম সাত পাহাড়ের শীর্ষে৷ ঐ ট্যাক্সি চালকের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে ভবনটিকে আমি প্রাসাদ ভেবে ছুটে চলছি তা আসলে প্রাসাদ নয়৷ ভবনটি একটি হোটেল৷

সাত পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছানোর পর প্রথমেই চোখে পড়ল পুরানো দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ৷ তারপরই চোখে পড়লো অপূর্ব সুন্দর অতিথিশালা বা হোটেল৷

হোটেলটির চারপাশে ঘুরে দেখছি৷ হোটেলটির নাম পেটার্সব্যার্গ৷ এর ফলকে লেখা গ্র্যান্ড হোটেল পেটার্সব্যার্গ৷

সাহস করে হোটেলটিতে ঢুকে গেলাম আমি৷ হোটেলটিতে ঢোকার পর পরিচয় হলো সেখানে কর্তব্যরত একজন মহিলার সাথে৷ ভদ্রমহিলার নাম রাইসা৷ তাঁর কাছ থেকে হোটেলটির ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পারলাম আমি৷ তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম, নৃবিজ্ঞানীদের মতে সাত পাহাড়ের মাঝে ৩৫০০ বছর পূর্বে ''কেল্ট'' নামক আদিবাসীর বসবাস ছিল৷ দ্বাদশ শতাব্দীতে সাত পাহাড়ের উপরে ভাল্টার রিটার নামের একজন বীরযোদ্ধা একটি ছোট কুটির নির্মাণ করে বসবাস করছিলেন৷ পরবর্তীতে ক্যাথলিক পাদ্রীরা তাঁকে অনুসরণ করে সেখানে একটি গির্জা স্থাপন করেন – যা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল৷ তারপর ক্যাথলিক পাদ্রীরা ১৭৬৩ সালে একই স্থানে আরেকটি গির্জা বা উপাসনালয় স্থাপন করে৷ যার নাম রাখা হয়েছিল পেটার্স উপাসনালয় – যা থেকে পরবর্তীতে পাহাড়টির নামকরণ করা হয় পেটার্সব্যার্গ৷ ১৮৩৪ সালে ইয়োসেফ লুডভিশ মার্টিন নামে একজন ব্যক্তি পুরো পেটার্সব্যার্গ কিনে নেন৷ তাঁর স্ত্রী সিবিলে মার্টিন সেখানকার গির্জাকে কেন্দ্র করে একটি গ্রীষ্মকালীন অবকাশকেন্দ্র স্থাপন করেন৷ সিবিলে মার্টিন ছিলেন একজন ব্যাঙ্কারের কন্যা, সেই সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন রাইনের রাণী হিসেবে৷ বিখ্যাত রোমান্টিক লেখক ভিলহেল্ম শ্লেগেল এবং এ্যার্নস্ট মোরিস আর্ন্ট'' সেখানে প্রায়ই বেড়াতে যেতেন৷

Luftaufnahme Luftfoto vom Petersberg bei Bonn
... যে ভবনটিকে আমি প্রাসাদ ভেবে ছুটে চলছি তা আসলে প্রাসাদ নয়৷ ভবনটি একটি হোটেল৷ছবি: presse

তারপর আমি ফ্রাউ রাইসাকে প্রশ্ন করলাম, কখন পেটার্সব্যার্গের এই ভবনটি হোটেলে পরিণত হয়৷ তিনি জানালেন, পরবর্তীতে নেলেস পরিবারের দুই ভাই এই জায়গাটি কিনে নেন এবং ১৮৯২ সালে সেখানে একটি হোটেল স্থাপন করেন৷ কিন্তু হোটেলটি সফলতা লাভ করেননি৷ তারপর ফ্যার্দিনান্দ ম্যুলেন্স নামে এক ব্যক্তি ঐ জায়গাটি কিনে নেন৷ তিনি ৪৭১১ নামের বিখ্যাত পারফিউম কোম্পানীর মালিক ছিলেন – যে পারফিউমকে গোটা বিশ্ব ‘ওডিকোলোন' নামে চেনে৷ তিনিই বর্তমান পেটার্সব্যার্গ হোটেলটি তৈরী করেন৷ ১৯৩০ সালে হোটেলের সঙ্গে একটি রেষ্টুরেন্ট নির্মাণ করা হয়৷ তাঁর সাথে কথা বলতে বলতে হোটেলের অপরদিকের দেওয়ালের কাছে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম এক অপূর্ব দৃশ্য৷ সেই দেয়ালের পাশে না দাঁড়ালে, নিজের চোখে না দেখলে সত্যিই বোঝা যাবেনা কত অপূর্ব মনোরম সেই দৃশ্য৷ সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম দূরে দাঁড়ানো পাহাড়গুলো৷ মেঘেরা মিশে গেছে পাহাড়ের সাথে৷ যেন মেঘের ওপর চেপে বসলে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চলে যাওয়া যাবে‌৷ ইস্, কি মজাই না হতো যদি মেঘগুলোকে বাহন বানানো যেত৷ আর সেই পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে রাইন নদী বয়ে চলছে৷ রাইন নদীর অপর পাড়েই ক্যোনিগসভিন্টার৷ এমনকি সেখানে দাঁড়িয়ে ‘দ্রাখেনফেল্স' বা ড্রাগনের টিলার চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়৷ অপূর্ব নৈসর্গিক স্থানের সামনে দাঁড়িয়ে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম৷

ফ্রাউ রাইসে আরো বললেন এই হোটেলটি সম্পর্কে৷ জানলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই হোটে‌লটি বিখ্যাত হয়ে যায়৷ কারণ এটি ''অ্যালায়েড হাই কমিশন'' হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে – যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রবাহিনীর দাপ্তরিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে৷ এ ব্যাপারে তারা জার্মান সরকারের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করে বিষয়টি পাকাপোক্ত করে নেন৷ ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভবনটি ‘অ্যালায়েড হাই কমিশন' মা মিত্রবাহিনীর দূতাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ এর অনেক পরে, ১৯৭৮ সালে জার্মান সরকার ১৮.৫ মিলিয়ন ডয়চে মার্ক দিয়ে ম্যুলেন্স পরিবারের কাছ থেকে জায়গাটি কিনে নেন৷ তারপর ১০০.৩৭ মিলিয়ন মার্ক দিয়ে হোটে‍লটিকে পুণঃ নির্মাণ করেন৷ এটি ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো৷ মাঝে এটি রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়৷ সেখানে রাষ্ট্রীয় অতিথিগণ হেলিকপ্টার নিয়ে চলে আসতেন৷ ১৯৯০ সালে যখন হোটেলটি পুণঃ নির্মিত হয়, সেখানে ধনী ব্যক্তিদের জন্য স্টাইনগেনব্যার্গার নামের বিখ্যাত হোটেল কোম্পানির একটি রেষ্টুরেন্ট তৈরী করা হয়৷ নাইন-ইলেভেনের পর আফগানিস্তানে তালেবানদের উৎখাত করার পর সেদেশে নতুন সরকার গড়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালে পেটার্সব্যার্গে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ আবারও ২রা ডিসেম্বর ২০০২ সালে আরও একটি আফগানিস্তান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ পুরো এলাকাটি বৈদ্যুতিক তার এবং নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা৷ এই হোটেলটিতে অনেক বিখ্যাত মানুষ বিয়ের অনুষ্ঠান পালন করেন৷ যেমন ১৯৯৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত ফর্মুলা ওয়ান মোটর চালক মিশায়েল শুমাখার এখানে করিনাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন৷

এরপর আমি মিসেস রাইসকে এত চমৎকার তথ্যপূর্ণ ইতিহাসের জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার কা‍ছ থেকে বিদায় নিলাম৷ আরেকবার সেই মেঘের সাথে মিশে যাওয়া পাহাড়ের দিকে তাকালাম৷ বিদায় জানালাম পাহাড়শৃঙ্গদের৷ ট্যাক্সিতে যখন বাড়ি ফিরছি তখন গোধূলি নেমেছে ধরনীতে৷